দরজার ঘণ্টা বাজল।
এসো! এসো! চেঁচিয়ে ডাকলাম। জলদি এসো!
দরজা খুলে উঁকি দিল মুসা।
খাঁচায় ঢুকে কী করছ, রবিন? মজা করছ নাকি?
না, মজা করছি না, বিড়বিড় করলাম। একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। মায়ানেকড়েটা আমার সঙ্গে চালাকি করেছে। মিষ্টি কথায় আমাকে ভুলিয়ে আমাকে দিয়ে তালা খুলিয়েছে। তারপর আমাকে খাঁচায় আটকে রেখে চলে গেছে। জলদি, আমাকে বের করো। বাবাকে সাবধান করতে হবে।
ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল ও। চাবিটা কই?
তাই তো! চাবিটা কোথায়?
আমাকে তালা দিয়ে চাবি কোথায় রাখছে বাবা, খেয়াল করিনি। চাবি কোথায় রেখেছে দেখিনি।
ডেস্কের ড্রয়ারে দেখো তো! মুসাকে বললাম।
ড্রয়ার হাতড়ে দেখে মুসা বলল, এখানে নেই।
কিন্তু চাবিটা তো খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের!
মাথা ঠাণ্ডা করো, রবিন, মুসা বলল। আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে…
কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই!
আরে শোনো না, চাবির দরকার হবে না আমাদের।
হবে না?
না। আমি গিয়ে তোমার বাবাকে খুঁজে বের করে রেনের চালাকির কথা বলব। আঙ্কেল এসে খুলে দেবেন তোমাকে।
উঁহু, আমার পছন্দ হলো না।
কেন হলো না?
কেন হলো না? কেন হলো না?
কি জবাব দেব?
কারণ… জানালার বাইরে তাকালাম। ওখানে তোমাকে এখন যেতে দিতে চাই না আমি। চাঁদ উঠেছে। এখন বাইরে যাওয়াটা বিপজ্জনক।
হ্যাঁ, তা ঠিক। দ্বিধা করছে মুসা।
ঠিক আছে, চাবিটাই খুঁজে বের করি।
বাড়ির ভিতর খুঁজতে গেল ও। এদিকে শিরশিরানি শুরু হয়ে গেছে। আমার চামড়ায়।
কিন্তু আমি যে মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হচ্ছি, মুসাকে দেখতে দিতে চাই না। কী করব? কী করব তাহলে?
জলদি করো, মুসা। জলদি! চেঁচিয়ে বললাম। কণ্ঠের আতঙ্ক চাপা দিতে পারছি না।
চামড়া জ্বলতে শুরু করেছে আমার।
মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে।
চাবিটা বাবা কোথায় রাখল? সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি তো? গুঙিয়ে উঠলাম।
তারপর মনে পড়ল বিস্কুটের টিনটার কথা। বাড়ির সমস্ত বাড়তি চাবি ওই খালি টিনে রাখে মা-বাবা।
মুসা, রান্নাঘরের তাকে বিস্কুটের একটা খালি টিন আছে, ওটায় দেখো! চেঁচিয়ে বললাম।
পেয়েছি! একটু পরেই দৌড়ে এসে বসার ঘরে ঢুকল মুসা। উল্লসিত ভঙ্গিতে চাবিটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল।
জলদি করো! খোলো! খোলো!
খুলছি তো। অস্থির হচ্ছ কেন? খাঁচার তালাটা খুলে দিল ও।
এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাও! খাঁচা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। এখুনি। দেরি কোরো না।
টের পাচ্ছি পিঠে লোম গজাতে শুরু করেছে।
পাগল নাকি! এইমাত্র তো বললে, চাঁদ উঠেছে, এখন বাইরে বেরোনো ঠিক না!
কিন্তু এখানে থাকাও উচিত হবে না তোমার। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম। মায়ানেকড়েটা এখানে ফিরে আসতে পারে…অনেকদিন খাঁচাটায় থেকেছে…মায়ানেকড়েরা পুরানো জায়গায় ফিরতে ভালবাসে।
তাই নাকি?
ও, তুমি জানো না। কিন্তু আমি জানি। বাবা বলেছে। দৌড় দাও। জলদি!.
দরজার দিকে ছুটল মুসা।
পেশিতে ব্যথা করছে আমার।
দরজার নবে হাত দিয়েছে মুসা।
হাতের দিকে তাকালাম। হলুদ আর কালো লোম গজানো শুরু হয়ে গেছে।
মনে মনে বললাম, ফিরে তাকিয়ো না, মুসা! বেরিয়ে যাও! এদিকে তাকিয়ো না, প্লিজ!
আটাশ
নব ঘোরাল মুসা। গুড লাক, রবিন। আমাকে বলল ও।
জবাব দিলাম না। দাঁড়িয়ে আছি। আতঙ্কে যেন অবশ হয়ে গিয়ে।
দরজা খুলল ও।
ডানে তাকাল, বাঁয়ে দেখল। কিন্তু পিছনে আমার দিকে তাকাল না। একবারও। বিড়বিড় করে বলল, এখন বেরোনো বোধহয় নিরাপদ।
জবাব দিলাম না।
চাঁদটা দেখছে ও।
মাথা ব্যথা করছে আমার। আধা মানুষ আধা জন্তুতে পরিণত হয়ে গেছি।
আমি যাচ্ছি, রবিন, মুসা বলল। ফোন কোরো।
যাও, মুসা, বেরিয়ে যাও। মনে মনে বললাম। ঘুরো না এদিকে। চলে যাও, প্লিজ!
সাবধানে থেকো। বলে বেরিয়ে গেল মুসা। দরজাটা লাগিয়ে দিল।
ছুটে এলাম জানালার কাছে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তা। দিয়ে দৌড়াচ্ছে মুসা।
পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। দাঁত বেরোনোর প্রচণ্ড ব্যথা মাঢ়ীতে। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলাম। শেষ হয়েছে রূপান্তর। পুরোপুরি মায়ানেকড়ে হয়ে গেছি। আমাদের বাড়ির ছায়ায় জড়সড় হয়ে দাঁড়ালাম। ভাবছি। কোথায় যাব? কোথায় আছে রেন? সময়মত কী খুঁজে বের করতে পারব ওকে? ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভিতর।
মায়ানেকড়ে! মায়ানেকড়ে! মহিলাকণ্ঠে চিৎকার শোনা গেল।
বরফের মত জমে গেলাম।
বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে মেরে ফেলল! আবার শোনা গেল।
আমিও দেখতে পেলাম মায়ানেকড়েটাকে। আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আরেকটা বাড়ির পিছনে।
মহিলার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচে গরগর করছে ওটা। এক পা। এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। বাড়ির দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। মহিলার। কোণঠাসা করে ফেলেছে তাকে মায়ানেকড়েটা।
গর্জন করে দৌড় দিলাম।
এক লাফে নিচু দেয়াল ডিঙিয়ে ছুটলাম। ঝাঁপিয়ে পড়লাম মায়ানেকড়েটার গায়ে।
গর্জে উঠে কাত হয়ে পড়ে গেল মায়ানেকড়েটা। চমকে গেছে। সামলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল পরক্ষণে।
চোখ বড় বড় করে দেখছে মহিলা। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠে, পাক খেয়ে ঘুরে গিয়ে দৌড় দিল।
মায়ানেকড়েটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমাকে ঘিরে। চক্কর দিতে শুরু করল ওটা।
ধারাল দাঁত বের করে মুখ ভেঙচাল। হুমকি দিল আমাকে।