চুপ করে থেকে একটা মুহূর্ত ভাবলেন অফিসার-ইন-চার্জ। তারপর পিছিয়ে গেলেন।বেশ, নিয়ে যান। একটা সুযোগ দিলাম।
আরেকটা কথা, বাবা বলল। দয়া করে এ কথাটা ফাস করবেন না। আমার ছেলে মায়ানেকড়ে হয়ে যায়, এটা জেনে গেলে ও আর শহরে টিকতে পারবে না।
মাথা ঝাঁকালেন পুলিশ অফিসার।
পুলিশের গাড়িতে করেই আমাকেসহ বাবাকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা হলো। সারারাতের ছোটাছুটিতে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, গাড়ির সিটে নেতিয়ে পড়লাম।
বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটা ভাল বোধ করলাম। বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরের দিকে এগোনোর সময় বললাম, আরও আগেই তোমাকে জানাতাম। তুমি দুঃখ পাবে বলে জানাইনি।
কখন ঘটল এটা? কীভাবে? আঙুল চালিয়ে চুল সমান করল বাবা। চোখে বিষণ্ণতা। চেয়ারে বসে শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে দিল। তার চওড়া কাধ সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে।
বনের মধ্যে সেরাতে যখন আমার ওপর মায়ানেকড়েটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বাবাকে জানালাম। আমার কাঁধে কামড়ে দিয়েছিল। তখনই তোমাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, তুমি দুঃখ পাবে বলে জানাইনি।
হুঁ! বিষণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বাবা। দোষটা আমারই। মায়ানেকড়ে ধরার জন্য এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম! তোমার দিকে নজর রাখা উচিত ছিল আমার। এটা ঘটতে দেয়াই ঠিক হয়নি।
দুই হাতের তালুতে মাথা চেপে ধরল বাবা। বিড়বিড় করে বলল, তবে তোমাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার, রবিন।
ধন্যবাদ? কীসের জন্য, বাবা?
রেনকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল বাবা। ও মায়ানেকড়ে নয়। তুমি ঠিকই বলেছিলে। সারা দুনিয়ার সামনে, আমি খেলো হয়ে যেতাম, সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, গাধা বনে যেতাম।
উঠে দাঁড়াল বাবা। পায়চারি শুরু করল।
ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দৃঢ়কণ্ঠে বাবা বলল।
তোমাকে ভাল করার জন্য সবরকম চেষ্টা আমি করব। সবচেয়ে বড় ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করাব। দরকার হলে ওঝা, কবিরাজ, ফকির, সবার কাছে নিয়ে যাব। মায়ানেকড়েকে ভাল করার কোন না কোন উপায় নিশ্চয় আছে…
ফোন বাজল। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল বাবা।
অন্যপ্রান্তের কথা শুনতে শুনতে সরু হয়ে এল চোখের পাতা। শক্ত হলো মুখের পেশি। বলল, অসম্ভব! এ হতেই পারে না!
তারপর আরও কিছুক্ষণ শোনার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল।
কী হয়েছে, বাবা? কোনও সমস্যা?
থানা থেকে ফোন করেছিল। ভারি দম নিল বাবা। ছয়জন মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছে একটা মায়ানেকড়ে।
আমি কিছু করিনি! করার সুযোগই পাইনি! লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার থেকে। তুমি তো জানো!
হ্যাঁ, জানি, বাবা বলল। তুমি নও। সারারাত তোমাকে চোখে চোখে রাখা হয়েছে। তোমাকে যখন স্কুলের মাঠে আটকে ফেলা হয়েছে, ঠিক সে-সময় শহরের আরেকদিকে ঘটনাটা ঘটেছে।
তাহলে কে, বাবা? অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি।
রেন। এ ছাড়া আর কে? প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল বাবা।
ও আমাদের মিথ্যে কথা বলেছে। ও সত্যিই মায়ানেকড়ে। তোমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে।
রেনের চেহারাটা কল্পনা করলাম। এ রকম একজন মানুষ মায়া নেকড়েতে রূপান্তরিত হয়, বিশ্বাস হচ্ছে না আমার এখনও। কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। মানুষগুলো জখম হয়েছে, সেটা তো ঠিক।
আজ রাতে তো পূর্ণিমা, তাই না, বাবা? গলা কাঁপছে আমার।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল, বাবা। কাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ। আগামী শুক্লপক্ষের আগে আর মায়ানেকড়েতে পরিণত হবে না। ততদিন নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। শুধু আজকের রাতটা ভালয় ভালয় কাটাতে পারলেই হয়।
চোখ বুজে ভাবতে লাগল বাবা। কী করবে? জিজ্ঞেস করলাম।
আচমকা চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল বাবা। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। আজ রাতে পুলিশ নিয়ে রেনকে খুঁজতে বেরোব। সবাইকে রাইফেল নিতে বলব। ভাবতে কষ্টই হচ্ছে, রবিন, অন্যদিকে চোখ ফেরাল বাবা। রেনকে দেখামাত্র গুলি করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
সাতাশ
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বাবা তৈরি হচ্ছে। বসে বসে দেখছি আমি।
আলমারি থেকে তার রাইফেলটা বের করল বাবা।
ম্যাগাজিনের চেম্বারে রূপার তৈরি বুলেট ভরল। আগেই তৈরি করিয়ে রেখেছিল। ব্র্যাটভিয়ায়ও এই বুলেট নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে করে।
মায়ানেকড়ে মারতে কী সত্যিই রূপার বুলেট লাগে, বাবা? গায়ে। কাঁটা দিল আমার।
লোকে তো তাই বলে। সত্যি-মিথ্যে জানি না। কিন্তু ঝুঁকি নেব কেন?
এখন আমরা নিশ্চিত, হিউগ রেন সত্যিই মায়ানেকড়ে।
সময় হয়েছে, বাবা বলল। চলো।
বসার ঘরে নিয়ে এসে বাবা আমাকে খাঁচায় ঢুকতে বাধ্য করল।
এখানেই তুমি নিরাপদ, খাঁচার দরজার মস্ত তালাটা লাগিয়ে দিল। বাবা।
বসার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে।
রেনের কথা ভাবলাম। ভাবলাম, জাহাজে আমাকে বাঁচানোর কথা।
গলায় ঝোলানো মায়ানেকড়ের দাতাটা চেপে ধরলাম। রেনই এ জিনিসটা আমাকে দিয়েছে।
আসলে, দুবার আমার জীবন বাঁচিয়েছে ও। একবার নিজে, আরেকবার এ জিনিসটার সাহায্যে-বনের ভিতর বুনো কুকুরের দল এটা দেখেই আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়।
সুতরাং ওকে আমার বাঁচানোর চেষ্টা করা দরকার। অন্তত সাবধান করাটা তো জরুরি।
খাঁচার শিক চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চেঁচিয়ে বললাম, কে আমাকে মুক্ত করবে? কে ছেড়ে দেবে খাঁচা থেকে?