বড় টর্চের তীব্র আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিল আমার।
এই যে এখানে! চিৎকার করলেন একজন অফিসার। ঘরের। বাইরে দাঁড়ানো ঊর্ধ্বতন অফিসারের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললেন, সার, এই যে এখানে ও!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দ্রুত একবার সারা ঘরে ঘুরে বেড়াল আমার দৃষ্টি।
একটা জানালাও নেই। একটা ছাড়া আর কোন দরজাও নেই। বেরিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা দেলাম না।
দরজার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বিকট চিৎকার দিয়ে ভয়। দেখানোর চেষ্টা করলাম অফিসারকে।
এবং ভুলটা করলাম।
কোমরের খাপ থেকে পিস্তল খুলে আমার দিকে তাক করলেন। অফিসার। সার, জলদি আসুন! একা আটকাতে পারব না। আবার পালাবে।
পা বাড়ালাম।
থামো! আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন অফিসার। দাঁড়াও ওখানে। নইলে গুলি করব!
পিস্তলের ট্রিগারে চেপে বসতে শুরু করল তার আঙুল।
পঁচিশ
গুলি করবেন না! গুলি করবেন না! ও আমার ছেলে! বাবার চিৎকার শুনতে পেলাম। দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে।
অবাক কাণ্ড! বাবা কী করে বুঝল, আমি?
অফিসারকে ঠেলে সরিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল বাবা। আমাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করল, আমি ভাল আছি কী না। দরজা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, আলো ফুটতে আর কত দেরি। আমাকে বলল, ভোর হয়ে গেছে। বসে থাকো এখানে। আলো ফুটলেই তুমি নিরাপদ।
অফিসারকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাবা। বাইরে থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।
কিন্তু ও খুনী! বাইরে থেকে অফিসারের রাগত কণ্ঠ কানে এল আমার।
ওকে শেষ করে দেয়া দরকার! বলল আরেকটা কণ্ঠ।
নিজের দেহের দিকে তাকালাম। এখনও মায়ানেকড়েই আছি আমি। মানুষ হতে আর ঠিক কতক্ষণ লাগবে, জানি না।
বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। এখনও অন্ধকার।
সূর্য ওঠার অপেক্ষায় রইলাম। বুকের ভিতর জোরে জোরে লাফাচ্ছে উত্তেজিত হৃৎপিণ্ডটা।
মিস্টার মিলফোর্ড, আপনি ভুল করছেন, তৃতীয় আরেকটা ভারি কণ্ঠ বলল, ওই ভয়ানক প্রাণীটা আপনার ছেলে হতে পারে না!
ধাক্কা লাগল দরজার পাল্লায়। খুলে গেল আবার ঝটকা দিয়ে। ওকে মেরে ফেলাই ভাল!
কাঁপতে কাঁপতে একটা খড়ের গাদার আড়ালে লুকালাম।
না না; বললাম তো, ও আমার ছেলে! বাবা বলল। আবার টান দিয়ে লাগিয়ে দিল পাল্লাটা।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। চামড়ায় শিরশিরে অনুভূতি।
তর্কাতর্কি শুরু হলো বাইরে। পুলিশরাও একমত হতে পারছে না। কেউ বলছে, মেরে ফেলো। কেউ বলছে, থাক না, দেখা যাক।
বাইরে উত্তেজনা বাড়ছে। এদিকে আমার দেহটা আবার রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে।
ধূর, মেরেই ফেলা ভাল। এ-সব শয়তান বাঁচিয়ে রাখা উচিত না। লোকের হট্টগোলের সঙ্গে উত্তেজনাও বাড়ছে।
জলদি! জলদি! তাড়াতাড়ি বদলে যাও! নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে বললাম। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই।
আমার পায়ের চামড়া পুড়ছে। মাথা ব্যথা করছে। চামড়ার জ্বলুনিতে মনে হচ্ছে, গা থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ব্যথা হয়ে গেল।
ওই যে, শুনুন, কেমন চিৎকার করছে! ও আপনার ছেলে হতেই পারে না, মিস্টার মিলফোর্ড। ওটা একটা ভূত! শয়তান! নরকের ইবলিস!
গুলি করছেন না কেন? আরেকটা কণ্ঠ বলল।
আবার খুলে গেল দরজার পাল্লা। ঘরে ঢুকলেন একজন পুলিশ অফিসার। হাতে পিস্তল।
বাবা! দুর্বলকণ্ঠে ডাকলাম।
পিছন থেকে দৌড়ে এল বাবা। ঠেলা দিয়ে অফিসারকে সরিয়ে ছুটে এল আমার দিকে। রবিন! রবিন! আমাকে জড়িয়ে ধরল। ভেবো না! সব ঠিক হয়ে যাবে!
আমার দেহের দিকে তাকালাম। আমার মানবদেহ। পুরো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
ওনার ছেলেই তো! সত্যিই রবিন! চাপা ফিসফিসানি শুনতে পেলাম চারপাশ থেকে।
বাবা, কী করে বুঝলে তুমি? আমার কণ্ঠ এখনও দুর্বল। কী করে বুঝলে আমি মায়ানেকড়ে হয়ে গেছি?
ওটা। আমার গলায় ঝোলানো দাঁতটা দেখাল বাবা। ওটা দেখেই বুঝেছি, তুমি। তবে অনেক দেরিতে দেখেছি, তুমি ছাউনির দিকে দৌড়ে যাবার সময়। ইস্, আরও আগে দেখলে ভাল হত। অনেক ঝামেলা কমত।
হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম দাঁতটা।
আবার এটা আমার জীবন বাঁচাল।
চলো, বাড়ি চলো, বাবা বলল।
ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলাম। সকালের রোদ যেন হুল ফোঁটাল আমার চোখে। তাড়াতাড়ি বুজে ফেললাম। আবার যখন মেলোম, দেখি, অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ আমাকে দেখছে।
আমাদের হাতে দিন, থানায় নিয়ে যাই, বাবাকে বললেন একজন অফিসার। কঠিন হাতে আমার হাত চেপে ধরলেন।
ওকে ছেড়ে দিন, প্লিজ, অনুরোধের সুরে বাবা বলল।
কিন্তু মিস্টার মিলফোর্ড, আপনি তো বুঝতেই পারছেন না, ওকে ছেড়ে রাখাটা উচিত হবে না। বলে সহকর্মীদের দিকে তাকালেন। তিনি।
মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানাল সবাই।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমাদের ঘিরে ফেলল।
বাবা! দুর্বলকণ্ঠে ককিয়ে উঠলাম। আমাকে থানায় নিয়ে কী করবে?
ছাব্বিশ
ছেড়ে দিন ওকে, প্লিজ! আবার বলল বাবা। বাড়ি নিয়ে যাই। ও ইচ্ছে করে কারও ক্ষতি করেনি। ওর চিকিৎসা দরকার।
কিন্তু রাতে আবার যখন চাঁদ উঠবে, তখন? অফিসার বললেন। আবার তো মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে। বুঝলাম, নিজের ইচ্ছেয় ক্ষতি করে না। কিন্তু যেভাবেই হোক, করে তো।
আর পারবে না, বাবা বলল। আমি কথা দিচ্ছি, ও আর বেরোতে পারবে না। কারও ক্ষতি করতে পারবে না। সব দায়-দায়িত্ব আমার।