মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালাম। গেটের কাছে ভিতরের দিকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ।
কয়েকটা গাড়ির ব্রেক কষে দাঁড়ানোর শব্দ হলো। ওগুলোর হেডলাইটের তীব্র আলো এসে পড়ল মাঠে।
চোখ মিটমিট করলাম। সামনে এগিয়ে আসছে বাবা। ধীরে ধীরে আমার দিকে এগোচ্ছে।
তোমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আর পালাতে পারবে না, বাবা বলল। তোমার জারিজুরি খতম।
চব্বিশ
হ্যাঁ, নোড়ো না। ওভাবেই থাকো। আমার দিকে এগোতে এগোতে আবার বলল বাবা।
গেটের কাছে দাঁড়ানো পুলিশেরা নড়ছে না। নীরবে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।
হেডলাইটের আলোয় আমিও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাবার দিকে তাকিয়ে।
নিঃশ্বাসের শব্দ কানে এল। আমার পিছন থেকে।
পাক খেয়ে ঘুরলাম। দেরি হয়ে গেছে। আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন পুলিশ।
একজন বিশালদেহী দুঃসাহসী পুলিশ অফিসার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুই হাতে আমার পেট পেঁচিয়ে ধরলেন। ধস্তাধস্তি করতে করতে মাটিতে ফেলে দিলেন। অসম্ভব জোর তার গায়ে।
কিন্তু আমি এখন মায়ানেকড়ে। যত জোরই থাক, একজন মানুষ আমার সঙ্গে শক্তিতে পারার কথা নয়।
বিকট চিৎকার দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তার হাতে কামড় বসানোর চেষ্টা করলাম।
ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিলেন অফিসার। তবে আমাকে ছাড়লেন না। বাকি পুলিশেরা তাঁকে সাহায্য করতে এগোল। সবার হাতে বড় বড় লাঠি। আমাকে বাড়ি মারার জন্য উঁচু করে ধরল।
মরিয়া হয়ে ডানে, বাঁয়ে তাকালাম।
কোন পথ নেই।
চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে আমাকে। একটাই উপায়, গায়ের লোকটাকে সরিয়ে ফেলে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে পালানো।
প্রচণ্ড গর্জন করে উঠে ঝাড়া মারলাম। গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিলাম অফিসারকে। তারপর ছুটলাম বেড়ার দিকে।
ছুটতেই ছুটতেই লাফ দিলাম।
কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারলাম না। আটকে গেলাম বেড়ার ওপরে। আরও জোরে লাফ দেয়া উচিত ছিল। বেরিয়ে যেতে পারতাম তাহলে। পিছনের দুই পা কাটাতারে বেধে গেল। পেটের ওপর ঝুলে রইলাম।
আমার ভারে ডেবে গেল বেড়ার ওপরের দিকটা।
কয়েকজন পুলিশ এসে বেড়া ঝাঁকাতে শুরু করল। কয়েকজন লাঠি দিয়ে দমাদম বাড়ি মারতে লাগল আমার দেহের পিছনে। বেড়াটাও আমার ভার রাখতে পারছে না। প্রায় উল্টে পড়লাম মাটিতে। বেড়ার ভিতর দিকে।
লাফিয়ে উঠলাম পরক্ষণে। দৌড় দিলাম স্কুল বাড়িটার দিকে।
সিঁড়ির কাছে পৌঁছলাম। গেটটা খোলা। আর কোন উপায় না দেখে সিঁড়ি বেয়ে ছাতে উঠে গেলাম।
দল বেঁধে ছাতে উঠে এল পুলিশ।
কোণঠাসা করে ফেলতে চাইল আমাকে। ওরা জানে, মায়ানেকড়ে হই আর যা-ই হই, দোতলার ছাত থেকে লাফিয়ে পড়লে বাঁচব না। আর বাঁচলেও হাড়গোড় ভেঙে অকেজো হয়ে যাব। অনেক উঁচু।
আমাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ।
সিঁড়ির কাছ থেকে বাবার চিৎকার কানে এল, ছাড়বেন না! ওকে ছাড়বেন না!
কিন্তু আমি দমলাম না। দৌড় দিলাম। আমাকে ছুটে আসতে দেখে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল কয়েকজন পুলিশ। ওদের চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসার সময় আরও দু-তিন ঘা লাঠির বাড়ি খেলাম।
ছাতের কিনারে এসে লাফিয়ে পড়লাম পাশের বাড়িটার ছাতে। সেখান থেকে অন্য ছাতে।
অনেকটা নিরাপদ আমি এখানে। ওরা আমাকে ধরতে পারবে না। বুঝে বিশ্রাম নিতে বসলাম। কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয় পুলিশ। মাথার ওপরে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলাম।
মুখ তুলে তাকালাম। সোজা আমার ওপর নেমে আসছে পুলিশের হেলিকপ্টার। ওটার তীব্র উজ্জ্বল সার্চলাইটের আলো নীচের দিকে ফেলে ছাতে ছাতে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে।
গর্জন করে উঠলাম। একতলার ছাতে রয়েছি এখন। নীচে একবার মাটির দিকে তাকিয়ে দ্বিধা করলাম। তারপর লাফ দিলাম। বিড়ালের মত চারপায়ে ভর দিয়ে নিরাপদেই নামলাম মাটিতে। সরে এলাম বাড়ির ছায়ায়।
পাগলের মত কর্কশ চিৎকার করে চলেছে সাইরেন। মানুষের কলরব। টায়ারের আর্তনাদ, আর গাড়ির ইঞ্জিনের ভারি গোঁ-গোঁ শব্দ। দমকলের একটা গাড়ি আর বড় কয়েকটা লরি এসে ঘিরে ফেলেছে। আমাকে।
পিছনের আঙিনায় ঢুকে পড়লাম।
বাড়ির সমস্ত আলো জ্বলে উঠল। সাইরেন বেজেই চলেছে। বাড়ির লোকেরা হট্টগোল শুরু করেছে।
দিলাম দৌড়। কিন্তু এত পরিশ্রম সইতে পারছে না আমার ফুসফুস। মনে হলো পুড়ে যাচ্ছে।
থামো! নিজেকে বললাম।
বিশ্রাম নাও।
লুকানোর ভাল জায়গা খোঁজো।
আঙিনার একপ্রান্তে একটা ছাউনি ঘর দেখলাম। পুরোপুরি অন্ধকার।
পা টিপে টিপে নিঃশব্দে চলে এলাম ওটার কাছে। মাথা দিয়ে দরজায় ঠেলা দিলাম। তালা কিংবা খিলটিল কিছু লাগানো নেই। খুলে গেল পাল্লা।
ভিতরে ঢুকে পড়লাম। তারপর আবার মাথা দিয়ে ঠেলে লাগিয়ে দিলাম পাল্লা। প্রচুর খড় রয়েছে ঘরে। একটা সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখা একজায়গায়। ওটার কাছে দুটো খড়ের গাদার ফাঁকে ঢুকে পড়লাম।
পা কাঁপছে আমার। ব্যথা করছে।
বুকটা ওঠানামা করছে জোরে জোরে। লম্বা দম নিয়ে শান্ত করতে চাইলাম ফুসফুসটাকে।
ধীরে ধীরে কমে আসছে আমার হৃৎপিণ্ডের লাফানি।
সব ঠিক হয়ে যাবে, নিজেকে বোঝালাম। এখানে তুমি নিরাপদ। ভোর হতে দেরি নেই। আলো ফুটলেই মানুষে রূপ নেবে। তখন এক ফাঁকে এখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারবে।
লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ মুদলাম। আর ঠিক তখুনি ঝটকা দিয়ে খুলে। বেড়ার গায়ে দড়াম করে বাড়ি খেল দরজার পাল্লা।