কিন্তু সেটা তো কুকুরটাকে খাওয়ার আগে! মুসা বলল। আমার ড্যানিকে খেয়ে ফেলার আগে!
মোলায়েম গোঙানি বেরোল আমার মুখ থেকে।
গতরাতে আমি ড্যানিকে খেয়েছি! আমার বন্ধুর কুকুরটাকে খেয়ে। ফেলেছি!
মুসা, এখন রাখি। আমার শরীর ভাল নেই। শুতে যাচ্ছি। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিসিভার রেখে দিলাম।
পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। বমি আসছে।
বহু কষ্টে ঠেকালাম। টলতে টলতে নিজের ঘরে ফিরলাম। জানালাগুলো টেনেটুনে দেখলাম। পেরেকগুলো ঠিকমত লেগেছে কী না দেখে নিশ্চিত হলাম।
তারপর দরজার পাল্লা লাগালাম। তাতে আড়াআড়ি তক্তা বসিয়ে পেরেক ঠুকে আটকে দিতে লাগলাম। সবশেষে কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে এমন গিঁট দিলাম, যাতে কোনমতেই খুলতে না পারি। দড়ির আরেকমাথা বাঁধলাম ভারি ড্রেসিং টেবিলটার সঙ্গে।
টান দিয়ে দেখলাম। না, খুব শক্ত হয়েছে। আজ রাতে আর বেরোতে পারব না। এই দড়ি আর পেরেক আমাকে আটকে রাখবে।
বাইশ
বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি।
ধীরে ধীরে অস্ত যেতে দেখলাম সূর্যটাকে।
গোধূলি থেকে রাত। আকাশে গোল চাঁদ। শিরশিরানি শুরু হয়েছে আমার চামড়ায়।
আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। হাতে, মুখে, সারাদেহে, লোম গজাতে আরম্ভ করেছে।
আমার পিঠ আর বুকে দপদপানি ব্যথা। চামড়ায় জ্বলুনি। ফুলতে শুরু করেছে পেশি। তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। পেশির চাপে ছিঁড়ে যাচ্ছে পরনের কাপড়।
মুখটা বদলে গিয়ে মায়ানেকড়ের মুখ হয়ে যাচ্ছে।
মাঢ়ী ফুড়ে বড় বড় দাঁত বেরোনোর সময় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম।
হাত-পায়ে যেন আগুন ধরে গেছে। আঙুল মিলিয়ে গিয়ে থাবা তৈরি হচ্ছে। তীক্ষ্ণধার নখ বেরোচ্ছে সেগুলো থেকে।
জ্বরে পুড়ছে যেন গা। পেটে রাজ্যের খিদে।
কুৎসিত, ভয়ঙ্কর হাঁক ছেড়ে কামড়াতে লাগলাম দড়িটা। কিছুটা কেটে হ্যাঁচকা টান দিতেই পট করে ছিঁড়ে গেল।
বুনো চিৎকার দিয়ে থাবা মারলাম দরজায় আটকানো তক্তায়। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খুলে পড়ল ওটা।
ছুটে বেরোলাম দরজার বাইরে। বাড়ির বাইরে এলাম।
ছুটতে শুরু করলাম চারপায়ে ভর দিয়ে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস পরশ বোলাচ্ছে তপ্ত চামড়ায়।
ছুটছি, ছুটছি। রক্তলালসায় দৌড়ে চলেছি রাস্তা দিয়ে। মাংস দরকার এখন আমার। কাঁচা মাংস।
তেইশ
মায়ানেকড়ের চোখ দিয়ে অন্ধকারে দিনের মত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। দুটো ছেলেকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখলাম।
ওদের আমি চিনি। আমার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ে। তীব্র খিদেয় মোচড় খেতে লাগল যেন পাকস্থলীটা।
ওদের ঘামের গন্ধ নাকে আসছে। নরম, তাজা মাংসের সুগন্ধ। পাচ্ছি। লম্বা জিভ বের করে ঠোঁট চাটলাম।
ছায়ায় গা ঢেকে চুপি চুপি এগোলাম ওদের দিকে।
কীসের শব্দ? আচমকা থেমে গেল একটা ছেলে। মুখ ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল আমার দিকে।
তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে সরে গেলাম।
এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে, সন্দেহজনক কিছু চোখে না পড়ায় আবার এগিয়ে চলল ওরা। গতি বাড়িয়ে দিয়েছে এখন।
ওদের ঘামের গন্ধ পাচ্ছি। ওরা যে ভয় পেয়েছে, তা-ও বুঝতে পারছি।
খিদে যেন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। খেতে হবে আমাকে। খেতেই হবে। এখুনি।
আবার দাঁড়িয়ে গেল ওরা। ফিরে তাকাল।
কেউ আমাদের অনুসরণ করছে, প্রথম ছেলেটা বলল।
জানি, দ্বিতীয় ছেলেটা বলল। আমারও একই ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। গা ছমছম করছে। কেঁপে উঠল ও।
এত আস্তে হাঁটলে হবে না। দৌড়াও।
ছুটতে শুরু করল ওরা।
ছায়া থেকে বেরিয়ে আমিও ছুটলাম। ভারি, চাপা গরগর শব্দ, বেরিয়ে এল গলার গভীর থেকে।
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল ওরা। আতঙ্কে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা।
মায়ানেকড়ে! ছেলেটা বলল। আবার মেয়েটার হাত চেপে ধরে টান দিল। ছুটতে শুরু করল ওরা।
চার পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমিও ছুটলাম।
ওই যে! ওই যে মায়ানেকড়ে! ধরো, ধরো! আমার পিছনে হট্টগোল শুনলাম।
ঘুরে দাঁড়ালাম। একটা পুলিশের গাড়ি আসছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছেন একজন পুলিশ অফিসার।
পিছনের জানালা দিয়ে আরেকটা মুখ বেরোতে দেখলাম। বাবা!
জলদি থানায় ফোন করুন। আরও লোক আসতে বলুন। উত্তেজিতকণ্ঠে বাবা বলল।
গাড়িটা ছুটে আসতে লাগল আমার দিকে।
ওটাকে দেখেছি। পিছু নিয়েছি। ওয়্যারলেসে কথা বলছেন অফিসার। থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন।
জোরে দৌড়াতে শুরু করলাম।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল গাড়ির দরজা। লাফিয়ে নেমে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলেন দুজন পুলিশ অফিসার।
পালাচ্ছে!
ধরো!
আমার কানে বাজতে থাকল যেন তাদের চিৎকার।
চারপায়ে ছুটছি। হাঁপাচ্ছি। বুকের ভিতর লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। তবে গতি কমালাম না। বরং আরও জোরে দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম।
একটা মোড়ের কাছে পৌঁছলাম। ছুটে রাস্তা পেরোলাম। পিছনে। সাইরেনের শব্দ। ফিরে তাকালাম। লাল-নীল আলোগুলো তীব্র ঝিলিক দিয়ে দিয়ে ঘুরছে।
জোরে! আরও জোরে! দৌড়াও! থেমো না! নিজেকে বললাম।
পিছনে দুপদাপ পায়ের শব্দ। ছুটে আসছে আমার দিকে।
স্কুলের দিকে ছুটলাম। মাঠে ঢুকে পড়লাম।
কিছুতেই পালাতে দেবেন না! বাবার চিৎকার কানে এল। ঝনঝন করে খুলল আর বন্ধ হলো লোহার গেটটা।