মায়ানেকড়ের মত দেখতে! খোদা! গুঙিয়ে উঠলাম।
চিবানো বন্ধ করে তাকিয়ে আছি টেলিভিশনের দিকে। তৃতীয় লোকটির কী হলো, বলুন? প্লিজ! চিৎকার করে উঠলাম। বলুন! ও কী। মারা গেছে?
তৃতীয় লোকটি…
দম আটকে ফেললাম।
…কয়েকটা আঁচড় লেগেছে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাকে।
ফোঁস করে বের করে দিলাম ফুসফুসে আটকানো দমটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস।
কয়েকটা কুকুরকেও আক্রমণ করেছে ভয়ানক প্রাণীটা, রিপোর্টার বলছে। ছোট একটা বিদেশী কুকুরকে খেয়ে ফেলেছে।
খোদা! এ কী করলাম আমি? একা একাই চেঁচিয়ে বললাম। সব আমার দোষ। মায়ানেকড়েটাকে ছেড়ে দিয়েছি আমি। রেন আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে।
টেলিভিশন বন্ধ করে দিলাম। আর শুনতে চাই না।
রেন সত্যিই একটা মায়ানেকড়ে, গুঙিয়ে উঠে বিড়বিড় করলাম। বাবার কথাই ঠিক! তার কথায় সন্দেহ করা উচিত হয়নি আমার।
পেটের ভিতর পাক দিয়ে উঠল। সারা শরীর কাঁপতে লাগল।
বাবা আমাকে কোনদিন, কোনওদিন ক্ষমা করবে না।
সারা দুনিয়া আমাকে ক্ষমা করবে না।
টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। চিরকাল এখানে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
মেঝেতে চোখ পড়ল। আমার কিছু কাপড়চোপড় ছড়িয়ে পড়ে আছে। এখানে কেন?
সরিয়ে রাখার জন্য তুলে নিলাম। ভাল করে তাকাতেই মুখ দিয়ে অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে গেল আপনাআপনি।
আমার একটা শার্ট আর প্যান্ট। গতকাল যেগুলো পরেছিলাম। ছিঁড়ে ফালা ফালা। রক্তের দাগ লাগা।
বিশ
আমার কাপড়ে রক্ত কেন? কী করেছি? গায়ে তো কোথাও জখম নেই।
চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করলাম, গতরাতে কোথায় ছিলাম? কী করেছি?
মনে পড়ল, শরীর খারাপ লাগছিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সর্বনাশ! হঠাৎ সব কথা মনে পড়ে গেল আমার। আয়নার দিকে তাকিয়েছিলাম। তাতে একটা রোমশ প্রাণীকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। জানালা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়েছিলাম।
ঝট করে চোখ চলে গেল জানালার দিকে।
হ্যাঁ, এখনও খোলা।
সব মনে পড়েছে। মায়ানেকড়ে হয়ে গিয়েছিলাম। চার পায়ে ছুটছিলাম।
মায়ানেকড়ে হয়ে গিয়েছিলাম! হাত-পা প্রবলবেগে কাঁপতে শুরু করেছে আমার। কাল রাতে আমিই তা হলে হামলা চালিয়েছি ওই মানুষ আর কুকুরগুলোর ওপর!
বিছানায় বসে ভাবতে লাগলাম। কাঁধে মায়ানেকড়ের কামড় খেয়ে আমিও মায়ানেকড়ে হয়ে গেছি। হতাশ ভঙ্গিতে জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগলাম।
এই কারণেই আমাকে দাঁতটা দিয়েছিল, বুঝতে পারছি এখন। স্বজাতি হিসেবে আমাকে ক্ষমতাবান করেছিল, বনের ভিতর আমাকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, যেহেতু আমি ছোট।
পেটের ভিতর খামচে ধরা অনুভূতি হচ্ছে।
গতরাতে ওই ভয়ানক কাণ্ডগুলো আমিই ঘটিয়েছি, রেন নয়। তারমানে আমাকে ফাঁকি দিয়ে বেরোয়নি। মিথ্যে কথা বলেনি।
উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।
এখন আর লোম নেই মুখে।
ডোরাকাটা দাগ নেই।
থাবা নেই।
হাঁ করলাম। শ্বদন্ত নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপরই মনে পড়ল চাঁদের কথা।
আজকে পূর্ণিমার আগের দিন। আজও চাঁদ উঠবে। গোল চাঁদ। আর চাঁদ উঠলেই মায়ানেকড়েতে পরিণত হব।
উহ্, এখন আমি কী করব?
কেউ যদি আমাকে বাঁচাত!
আমাকে সাহায্য করত!
ঘরে বন্দি করে রাখত আমাকে! যাতে আমি বেরোতে না পারি।
আর কাউকে জখম করতে চাই না আমি!
বাবা! বাবা! বেডরুম থেকে ছুটে বেরোলাম। বসার ঘরে চিলাম। বাবা, আমিই মায়ানেকড়ে! রেন নয়!
একুশ
কিন্তু বসার ঘরে বাবা নেই।
বাবা! কোথায় তুমি?
জবাব এল না।
ছোট টেবিলে একটুকরো কাগজ দেখলাম। ফ্লাওয়ার ভাস চাপা দেয়া।
এগিয়ে গিয়ে ভাস সরিয়ে কাগজটা তুলে নিলাম। বাবা লিখে রেখে গেছে:
রবিন,
গতরাতে মায়ানেকড়েটা হামলা চালিয়েছে। থানায় যাচ্ছি পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে! কখন ফিরব জানি না। স্কুল থেকে সোজা বাড়ি ফিরবে। রাতে শক্ত করে দরজা-জানালা আটকে রাখবে। কোন কারণেই বেরোবে না।
-বাবা।
এখন আমি কী করব? গুঙিয়ে উঠলাম।
নিজের বেডরুমে নিজেকে আটকে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় দেখলাম না। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বেরোতে না পারি। আর বেরোতে না পারলে কাউকে জখমও করতে পারব না।
স্কুলে আজ যাব না। রাতের জন্য তৈরি হতে হবে। তাতে সময় লাগবে।
তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে বাড়ি থেকে বেরোলাম। বাজারের একটা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে বেশ কিছু বড় বড় পেরেক, মোটা দড়ি, আর কাঠের দোকান থেকে শক্ত তক্তা কিনলাম।
দোকানদাররা আমাকে চেনে। এ-সব দিয়ে কী হবে, জিজ্ঞেস করল। বললাম, বাবা নিতে বলেছে। কী করবে জানি না। জিনিসগুলো নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরলাম। দেরি না করে কাজে লাগলাম।
প্রথমেই জানালার পাল্লাগুলো পেরেক গেঁথে এমনভাবে বন্ধ করলাম, যাতে টানাটানিতে না খোলে। শেষ পেরেকটাতে হাতুড়ির শেষ বাড়িটা দিয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বাজল। ধরলাম। মুসা করেছে।
রবিন? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! ছোট্ট ওই মানুষটা মায়ানেকড়েতে পরিণত হয়েছে!
সত্যি কথাটা মুসাকে বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, আমিই মায়ানেকড়ে।
ওই দানবটা বেরোল কীভাবে? মুসা জানতে চাইল।
আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তুমি ছেড়ে দিয়েছিলে? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পাগল হয়ে গিয়েছিলে, না কী?
কেন, পাগল হব কেন? আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম। তুমিই তো বলছিলে, রেন মায়ানেকড়ে হতে পারে না। আমার বাবা পাগলামি করছে। রেনকে ছেড়ে দিতে চাপাচাপি করেছিলে।