স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি লোকটার দিকে। ওর চোখের আকুতি দেখছি।
ছেড়ে দেব? সত্যিই দেব ছেড়ে?
প্রশ্নটা প্রচণ্ড গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মগজে।
ভাবলাম, জাহাজে আমার জীবন বাঁচিয়েছে ও। ওর কাছে এমনিতেই ঋণী হয়ে আছি। তা ছাড়া বাবাকে ভুল করা থেকে
নোটাও আমার কর্তব্য। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, রেনকে ছেড়ে দেব। বাবা কোন ড্রয়ারে চাবি রাখে জানি। ড্রয়ার থেকে চাবিটা বের করলাম। খুলে দিলাম খাঁচার তালা।
আঠারো
খাঁচা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল রেন। থ্যাংক ইউ, রবিন! থ্যাংক ইউ! তোমার কথা আমার মনে থাকবে!
আমার ডান হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল ও। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ঘণ্টাখানেক পর, ড্রাইভওয়েতে বাবার গাড়ি ঢোকার শব্দ শুনলাম।
ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল বাবা, কি, এত উত্তেজিত কেন? আজ রাতে মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে রেন, সেটা দেখার জন্যে?
না, বাবা, আমতা আমতা করে বললাম। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।
চলো, বসার ঘরে।
না, দাঁড়াও, আমি ওর হাত আঁকড়ে ধরলাম। ওখানে এখন যেয়ো না।
কেন? কী হয়েছে? আমার চোখে স্থির হলো বাবার দৃষ্টি।
আমি…আমি রেনকে ছেড়ে দিয়েছি।
কী করেছ?ঝাড়া দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বসার ঘর ঢুকল বাবা। শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে অবিশ্বাস। কী করে পারলে? চেঁচিয়ে উঠল বাবা। ইশশ! কী করে করতে পারলে এমন একটা কাজ! ঘরের ভিতর পায়চারি শুরু করল বাবা।
লোকটার জন্য আমার মায়া হচ্ছিল, বাবা, মিনমিন করে বললাম। তা ছাড়া, আমি…আমি তোমাকে ভয়ানক একটা ভুল করতে দিতে চাইনি। সবাই তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, বাবা।
তুমি জানো, তুমি কী করেছ? পায়চারি থামিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল বাবা। তুমি একটা মায়ানেকড়েকে ছেড়ে দিয়েছ! এত জোরে, চেঁচিয়ে বলল বাবা, গলার দুই পাশের রগ ফুলে উঠল। আজ রাতে ওটা কী করবে, জানো তুমি? মায়ানেকড়েতে পরিণত হবে, তারপর নিরীহ মানুষ মারতে শুরু করবে। আর তারজন্য দায়ী থাকবে তুমি।
কিন্তু বাবা…
আর একটা কথাও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই না আমি! চিৎকার করে বলল বাবা। তোমার মুখ দেখতে চাই না। তুমি এখন তোমার ঘরে যাও।
নিজের ঘরে এসে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি জানি,। ঠিক কাজই করেছি, নিজেকে বোঝালাম।
কিন্তু বাবা কী আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবে?
হ্যাঁ, বাবার চিৎকার কানে এল। ফোনে তার সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। তুমি ব্যবস্থা করো। দরকার হয় পুলিশের কাছে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে বলো। সূর্য ডোবার আগেই ওটাকে ধরতে না পারলে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে।
আবারও ভুল করতে যাচ্ছে বাবা। রেন মায়ানেকড়ে হতেই পারে না।
কিন্তু হঠাৎ এ রকম অসুস্থ বোধ করছি কেন?
মাথা ব্যথা করছে। কেমন শূন্য লাগছে মাথার ভিতরটা।
চোখ বুজলাম।
আবার যখন চোখ মেলোম, দেখি, বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
বিছানায় উঠে বসলাম। বনবন করে ঘুরতে শুরু করল যেন ঘরটা।
কী হয়েছে আমার? পেট খালি বলেই বোধহয় এমন লাগছে। খেলেই ঠিক হয়ে যাবে, ভাবলাম।
বিছানা থেকে নামলাম। দেয়ালে লাগানো আয়নার দিকে চোখ পড়তে চিৎকার করে উঠলাম।
নাকের নীচে বড় বড় গোঁফ গজাতে শুরু করেছে আমার। হাতে, পায়ে, বড় বড় লোম। মানুষের মুখ মিলিয়ে গিয়ে সেখানে একটা জানোয়ারের মুখ দেখা দিচ্ছে।
হাঁ করলাম। বড় বড় দাঁত বেরোচ্ছে মাঢ়ী থেকে।
সর্বনাশ! মায়ানেকড়ে হয়ে যাচ্ছি আমি! গুঙিয়ে উঠলাম।
জানালার দিকে দৌড় দিলাম। ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম বাইরে। মাটিতে নামলাম চারপায়ে ভর দিয়ে। হাতের জায়গায় দুটো পা-ও
মাটিতে পড়েই ছুটতে আরম্ভ করলাম। আমাদের পিছনের আঙিনা দিয়ে দৌড়ে চললাম। রাস্তায় বেরিয়ে এলাম।
দৌড়… দৌড়… আমার তপ্ত চামড়ায় আরামের পরশ বোলাচ্ছে ঠাণ্ডা বাতাস…
উনিশ
চোখ মেললাম।
চোখে রোদ পড়তে ঝট করে বন্ধ করে ফেললাম আবার।
আমি কোথায়?
ভঙ্গিতে চারপাশে তাকালাম।
আমার বেডরুমের মেঝেতে পড়ে আছি কেন? বিছানা থেকে পড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাত-পা টান টান করলাম। বড় করে হাই তুললাম।
এত ক্লান্তি। যেন সারারাত ঘুমাইনি।
ঘুমানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু পারব না। এখন বিছানায় পড়ে থাকলে রেগে যাবে বাবা। হাই তুলতে তুলতে নাস্তা করার জন্য খাবারঘরের দিকে চললাম।
এক গ্লাস কমলার রস, দুই টুকরো রুটি, আর মাখন বের নিয়ে খেতে বসলাম। একটা তাকে রাখা ছোট টেলিভিশনটা চালু করা। বাবা রেখেছে। খেতে বসে বাবা টেলিভিশন দেখতে পছন্দ করে।
কাল রাতে দুই মহিলা আর একজন পুরুষের ওপর ভয়ঙ্কর হামলা চালিয়েছে একটা অজানা প্রাণী, টেলিভিশনের খবরে বলল।
আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুই মহিলাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
অজানা প্রাণীর ভয়ঙ্কর হামলা? আমাদের এই ছোট্ট শহরে?
ঘটনাটা কী? অবাক হয়ে ভাবলাম। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছি।
একজন ভদ্রমহিলা সব দেখেছেন। তিনি এখন আমাদের সঙ্গে আছেন। কী দেখেছেন, আমাদের জানাবেন। ক্যামেরার চোখ ঘুরে গেল সাতাশ-আটাশ বছর বয়েসের এক মহিলার দিকে।
একটা মায়ানেকড়ের মত বুনো জানোয়ার! বলতে গিয়ে গলা কাঁপছে মহিলার। জীবনে এ রকম জানোয়ার দেখিনি আমি। ভয়ানক! ভয়ানক!