আমাকে দেখালে কিছু বলবেন না।
তা অবশ্য ঠিক। ভেবে নিয়ে বললাম, চলো।
এই সময় ঘরে ঢুকল মুসার কুকুর ড্যানি। কুকুরটাকে নতুন জোগাড় করেছে ও। বিদেশী একটা ছোট জাতের কুকুর।
উহ্-হুঁ! তোর কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম রে, ড্যানি। রবিন, তুমি বাড়ি যাও। আমি আসছি।
কোথায় যাবে?
ড্যানিকে একটু হাঁটিয়ে নিয়ে আসি। হ্যাঁনসবেরিতে ডগ শো হবে। ভাবছি, ওকে নিয়ে যাব। এবার ফাস্ট প্রাইজটা বাগাতেই হবে। তাই ওর পিছনে খাটতে হচ্ছে।
বাড়ি ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের বাড়ি এল মুসা।
ওকে বসার ঘরে রাখা খাঁচাটা দেখালাম। ওই যে।
খাঁচার চারপাশে ঘুরতে লাগল মুসা। রেনকে খুঁটিয়ে দেখল। চোখে হতাশা।
খাঁচার মেঝেতে আসনপিড়ি হয়ে বসেছে রেন। বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে মাথা। বাঁকা হয়ে আছে কাঁধ।
মুসাকে ঘুরতে দেখে মাথা তুলল ও। মুখে মলিন হাসি ফুটল। তারপর আবার মাথা নিচু করল।
কিন্তু, রবিন, এ তো একজন মানুষ। স্বাভাবিক মানুষ। ওকে আটকে রেখেছ কেন? এ তো অন্যায়…
আমি কী করব? ভোতাস্বরে জবাব দিলাম। বাবা ওকে ধরে এনেছে। ও নাকি মায়ানেকড়ে।
জোর দিয়ে একই কথা বলল মুসা, এ লোক মায়ানেকড়ে হতেই পারে না।
কী বলব?
রেন যে মায়ানেকড়ে নয়, এটা তো আমিও জানি।
নাহ, এ লোকটাকে মোটেও মায়ানেকড়ে মনে হচ্ছে না আমার।
খাঁচা ঘেঁষে দাঁড়াল মুসা।
ও কী করছে আমি বুঝে ওঠার আগেই শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রেন।
মুসা, খাঁচার কাছ থেকে সরো! চেঁচিয়ে উঠলাম।
সতেরো
ভয় নেই, চকলেট দিলাম, মুসা বলল এমনভাবে নিল, যেন কতকাল খাবার পায় না। খেতে দাও না নাকি?
নিশ্চয়, বিড়বিড় করলাম। সকালেও তো পেট ভরে খাইয়েছে। ওকে বাবা।
চকলেট নিয়ে মুসাকে ধন্যবাদ দিল রেন। মোড়ক খুলতে খুলতে বলল, আমার নাম হিউগ রেন। আমি মায়ানেকড়ে নই, বুঝলে। ওরা ভুল করছে। বার বার বলছি। শুনছে না।
চোখের পাতা সরু করে আমার দিকে তাকাল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, তোমার বাবা পাগল হয়ে গেছেন! বদ্ধ উন্মাদ!
আহ, আস্তে বলো!
আস্তে বলব কেন? তোমার বাবা তো সত্যি সত্যি পাগল। নেহায়েত তোমাকে কথা দিয়েছি, কাউকে বলব না। নইলে এখুনি। গিয়ে পুলিশকে জানাতাম।
আর একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল মুসা।
রেনের দিকে তাকালাম। আবার আসনপিড়ি হয়ে বসেছে খাঁচার কোণে। কামড় দিয়ে চকলেটের একটা কোণা ভেঙে মুখে পুরল।
খুবই করুণ অবস্থা ওর। ওর জন্য খারাপ লাগছে আমার।
ভাবছি, কিছু একটা করা দরকার। এভাবে আটকে রাখাটা ঠিক, হচ্ছে না।
কিন্তু কী করব? কী করতে পারি আমি?
.
পরদিন কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনতে বাজারে গেলাম। বাজার সেরে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করল না আমার। রেনের দিকে তাকানোর ভয়ে। তাকালেই মায়া লাগে। ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। বাবাকেও বোঝাতে পারি না, আমিও সহ্য করতে পারি না। বিপদেই পড়া গেছে! ওর বিষণ চোখ দুটোর দিকে তাকালে রীতিমত কষ্ট হতে থাকে আমার। খাঁচার ভিতর বন্দি জানোয়ারের মত যখন অসহায় ভঙ্গিতে পায়চারি করে, তখন আরও খারাপ লাগে।
কিন্তু বাড়ি তো ফিরতেই হবে। ভাবলাম, যাব, কিন্তু রেনের দিকে। তাকাব না।
ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজা লাগালাম। কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছি, কানে এল রেনের মোলায়েম কণ্ঠ, রবিন, এলে?
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। হ্যাঁ, এলাম।
একবার এদিকে আসবে?
কি আর করব? খাঁচার দিকে এগোলাম।
রবিন, বাবা, আমার কথা শোনো। উঠে দাঁড়িয়েছে রেন। খাঁচার শিকে গাল চেপে ধরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মায়ানেকড়ে নই। আমাকে ধরে আনার আগে বন বিভাগের লোকের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল তোমার বাবার। ওরা তাকে বোঝাতে পারত। আমার নাম সত্যিই হিউগ রেন। বন বিভাগের অনুমতি নিয়েই আমি বনে জানোয়ার। শিকার করি।
আমি দুঃখিত, মাথা নেড়ে বললাম। আমি কিছুই করতে পারব না।
ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রাখলাম। ব্যাগের পকেট হাতড়ে বত সাইজের একটা চকলেট বের করে বাড়িয়ে দিলাম।
কোথায় পেলে ওটা? আমি সোজা হতেই জিজ্ঞেস করল রেন
দোকান থেকে কিনেছি।
চকলেট না, আমি ওটার কথা বলছি। আমার গলার দিকে তাকিয়ে আছে ও। মায়ানেকড়ের দাঁত!
সেটা তো আপনিই ভাল বলতে পারবেন, অন্ধকারে ছিল ছুঁড়লাম। রেনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছি। বনের ভিতর মায়ানেকড়ে হয়ে, আমার তাঁবুতে ঢুকে আপনি দেননি?
দাঁতটার দিকে তাকিয়ে আছে রেন। চেহারায় পরিবর্তন ঘটল না
আমি মায়ানেকড়ে নই। আমি একজন ফার শিকারি।
তাহলে এটার কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন? জিজ্ঞেস করলাম।
অদ্ভুত একটা জিনিস গলায় ঝুলিয়ে রেখেছ তো, তাই।
খাঁচার শিকের ফাঁক দিয়ে চকলেটটা বাড়িয়ে ধরলাম।
আমাকে তুমি সাহায্য করো, রবিন, রেন বলল।
সরি, মাথা নাড়লাম। সত্যিই আপনাকে সাহায্য করতে ইচ্ছে। করছে। কিন্তু আপনাকে ছেড়ে দিলে বাবা ভীষণ রেগে যাবে।
কিন্তু তুমি কী চাও, তোমার বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে ভরুক পুলিশ? লোকে হাসুক? বন্ধুদের ইয়ার্কির যন্ত্রণায় রাস্তায় বেরোতে পারবে না তুমি, স্কুলে যেতে পারবে না। তোমার জীবনটাও নরক হয়ে যাবে।
তো?
আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, রবিন, আমাকে ছেড়ে দেয়ার কথা কাউকে কিছু বলব না। আমাকে ছেড়ে দাও। তাতে তোমার বাবার উপকারই করা হবে।