আপনি ভুল করছেন, রেন বলল। বাবার থাবা থেকে হাত ছাড়ানোর জন্য মোড়ামুড়ি করছে। আমাকে ছেড়ে দিন। বাড়ি যেতে দিন। কথা দিচ্ছি, কাউকে কিছু বলব না। পুলিশের কাছে নালিশ করব না। যা ঘটেছে, সব ভুলে যাব।
ওর কথা কানেই তুলল না বাবা। তাঁচকা টানে সরিয়ে নিল আমার কাছ থেকে। চেঁচিয়ে খালাসিদের ডাকতে লাগল।
বাবা আর খালাসিরা মিলে রেনকে আবার কার্গো হোন্ডে নিয়ে গেল। একটু পরে ফিরে এসে আমাকে কেবিনে নিয়ে চলল বাবা। যেতে যেতে বলল, এবার ভালমত টেনেটুনে দেখেছি। আর হাতকড়া খুলতে পারবে না।
কিন্তু হাতকড়া খুলে যাওয়ার ঘটনাটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার। মায়ানেকড়ের দাঁতটার কথা মনে পড়ল। এবারও এটাই আমাকে বাঁচায়নি তো? কোনও অলৌকিক ক্ষমতাবলে হাতকড়া খুলে দিয়ে রেনকে পাঠিয়ে দেয়নি তো আমার কাছে?
আমাকে কেবিনে রেখে চলে গেল বাবা। নিশ্চয় কোনও কাজে।
ভেজা জামাকাপড় বদলে শুকনো কাপড় পরলাম। তারপর বিছানায় বসে ছোট্ট গোল জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। না, সাগরের উত্তাল ঢেউ দেখছি। জাহাজের গায়ে বিপুল গতিতে ক্রমাগত বাড়ি মেরে চলেছে।
আবার পাক দিচ্ছে পেটের ভিতর। বমি আসতে চাইছে।
রাতের আকাশের দিকে তাকালাম। ভারি মেঘ কেটে যাচ্ছে। মেঘের ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ
আবার মাথা ঘুরছে আমার। কাঁধে দপদপে ব্যথা।
আমাকে মায়ানেকড়েতে কামড়ানোর কথা বাবাকে বলিনি এখনও। তাকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলতে চাইনি। তবে এখন এমন ব্যথা করছে, না বলে বোধহয় আর পারব না।
শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। কাঁধের কাছে আহত জায়গাটা ডলতে গিয়ে আঁউ করে উঠলাম।
বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিলাম বাথরুমে।
একটানে শার্ট খুলে ফেললাম। আয়নায় তাকালাম নিজের দিকে।
এ কি!-আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম।
কাঁধের জখমটা লাল হয়ে আছে। কিন্তু চেঁচিয়েছি অন্য কারণে। কুৎসিত এক গোছা লোম গজিয়েছে জায়গাটায়।
পনেরো
মরিয়া হয়ে ডলতে শুরু করলাম জায়গাটা। তুলে ফেলতে চাইলাম চুলগুলো।
লাভ হলো না। বরং প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম।
এই চুল কীসের? এত কুৎসিত! চিন্তিত ভঙ্গিতে আবার শার্টটা গায়ে দিয়ে ঢেকে ফেললাম চুলগুলো।
বাথরুম থেকে বেরোতেই দেখি কেবিনে ঢুকছে বাবা।
বাবা, একটা জিনিস দেখাব তোমাকে।
এক সেকেণ্ড। গায়ের ভেজা হলুদ রেইনকোটটা খুলল বাবা। বাথরুমের হুকে ঝোলাল।
বাবা… আবার বলতে চাইলাম।
এক মিনিট, রবিন! ডেস্কের সামনে গিয়ে চেয়ারে বসল বাবা। মোবাইল ফোন বের করল। একটা জরুরি কথা সেরে নিই।
বিশ মিনিট পরও বাবার জরুরি কথা শেষ হলো না। আবার। অফুরন্ত কথা বলে চলেছে তার উকিলের সঙ্গে।
আমার কাঁধের চুলগজানো জায়গাটা জ্বলছে, সেইসঙ্গে প্রচণ্ড চুলকানি।
বাবা, আমার কথাটা শোনো! প্রায় ফিসফিস করে বললাম।
শুনব। শুনব। আমার দিকে তাকালও না বাবা। আবার গিয়ে বিছানায় উঠলাম।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে বালিশে মাথা রেখে চিত হলাম। চাদরটা টেনে দিলাম গলার কাছে। তাকিয়ে আছি বাবার দিকে। টেলিফোনে কথা বলছে। দুনিয়ার আর কোনদিকে খেয়াল নেই। এত খুশি বহুকাল দেখিনি তাকে।
বাবার এই আনন্দটা নষ্ট করতে চাইলাম না। কাঁধের কথাটা বললেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।
থাক, বলব না। ব্যথা আর কয়েক গাছা চুলই তো। বেশি তো না।
তাই আমার গোপন কথাটা তখনকার মত চেপে গেলাম। বাবাকে জানালাম না। তবে জানানো উচিত ছিল। তাহলে অনেক ঝামেলা আর সমস্যা থেকে বাঁচতে পারতাম।
ষোলো
নিরাপদেই রেনকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছলাম আমরা। জাহাজঘাটা থেকে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত সারাক্ষণ সঙ্গে ছিলেন বাবার সাংবাদিক বন্ধু। গাড়ি থেকে শুরু করে, সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তাই কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমাদের।
বাড়ি ফিরে দেখি, মা নেই। বাবা আর আমার জন্য একটা নোট রেখে গেছে। তার এক অসুস্থ বোনকে দেখতে গেছে আটলান্টায়। কবে ফিরবে ঠিক নেই।
বাবার সাংবাদিক বন্ধু আমাদের বসার ঘরের মাঝখানে মজবুত একটা লোহার খাঁচা এনে রেখেছেন। তাতে ভরা হলো রেনকে।
এখনও আমার বিশ্বাস হয় না, ছোটখাট ওই অসুস্থ মানুষটা মায়ানেকড়ে।
আমার আশঙ্কা, ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে বাবা। পূর্ণিমার সময় রেন মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত না হলে ওকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। বাবা। ও গিয়ে তখন পুলিশকে জানাবে। পুলিশ বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরবে। পাগলাগারদেও পাঠাতে পারে।
আগামীকাল রাতে ত্রয়োদশী। মোটামুটি গোল হয়ে যাবে চাঁদটা। আরও দুদিন পর পূর্ণিমা। সাপুড়ে বুড়ো বলেছিল, এই তিনটে রাতই খুব খারাপ। মানুষ মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হয়।
পরদিন বিকেলে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুসার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিশোরের কোন খবর আছে কি না। ও জানাল, কয়েক দিন আগে চিঠি দিয়েছে কিশোর। ওদেরও স্কুল ছুটি। তবে এবার গ্রীনহিলসে আসতে পারবে না। ওর চাচা রাশেদ পাশা ওকে আর মেরিচাচীকে নিয়ে অন্যখানে বেড়াতে যাবেন। হতাশ হলাম। কিশোর থাকলে ভাল হতো। রেনকে নিয়ে কী করব, আলোচনা করতে পারতাম।
মায়ানেকড়েটার কথা মুসাকে জানালাম।
লাফিয়ে উঠল মুসা, চলো, দেখব!
কিন্তু বাবা তো এখুনি কাউকে দেখাতে নিষেধ করেছেন।