উত্তেজনা সইতে না পেরেই বোধহয়, উঠে দাঁড়াল বাবা। ছোট্ট ঘরটায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করল। কানে ফোনটা লাগানোই আছে। ক্রমে জোরাল হচ্ছে তার কণ্ঠস্বর।
একপাশে অনেকখানি কাত হয়ে গেল জাহাজ। যখন মনে হলো, উল্টে যাবে, আবার সোজা হলো। তারপর অন্যপাশে কাত হলো।
জাহাজের সঙ্গে যেন দুলছে আমার পাকস্থলীটা। মাথা ঘুরছে। বমি পাচ্ছে।
একটু ধরুন তো, আমার দিকে তাকিয়ে আছে বাবা। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বলল, রবিন, কী হয়েছে? অসুস্থ লাগছে? তোমার চেহারা এমন হয়েছে কেন?
আমার ভাল লাগছে না, বাবা, গুঙিয়ে উঠলাম। এই দুলুনি সহ্য করতে পারছি না।
সি-সিকনেস, বাবা বলল। জাহাজে ওঠার অভ্যাস না থাকলে প্রথম প্রথম সবাই এ রকম অসুস্থ হয়ে পড়ে। দু-একদিন গেলেই ঠিক হয়ে যায়। ডেকে চলে যাও, খোলা বাতাসে। ভাল লাগবে। আমি ফোনটা শেষ করে আসছি।
টলতে টলতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। ডেকটা ওপরে।
প্রচণ্ড দোল খাচ্ছে জাহাজ। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় গোঙানি ঠেকাতে পারলাম না। ডেকে বেরিয়ে আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলাম।
বাইরে খুব ঠাণ্ডা। সেইসঙ্গে বাতাস। তবে আমার গরম হয়ে ওঠা গায়ে লাগতে অনেকটা আরাম পেলাম।
লম্বা দম নিলাম। বাতাসে নোনা গন্ধ। পেটের ভিতরের পাক দেয়া কমে এল। মাথা ঘোরাও কমছে। রেলিঙে হেলান দিয়ে অন্ধকার সাগরের দিকে তাকালাম।
রাতের আকাশের সঙ্গে সাগরের পানি যে ঠিক কোনখানটায় মিলেছে, দেখা যায় না।
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে নিশ্চয়। তবে মেঘে ঢাকা। তারাও দেখা যাচ্ছে না।
বাবার অপেক্ষা করছি। জোরাল বাতাস এসে গায়ে আছড়ে পড়ল। প্রচণ্ড দোল খেল জাহাজ।
রেলিং চেপে ধরলাম। বাতাস যে এভাবে ধাক্কা দিতে পারে, জানতাম না।
ঝড় আসছে! দূর থেকে ভেসে এল একজন খালাসির চিৎকার।
আরেক দফা জোরাল বাতাস এসে আছড়ে পড়ল জাহাজের গায়ে। সেইসঙ্গে নিয়ে এল ঢেউ। পাহাড়ের সমান।
পাগলের মত দুলছে জাহাজটা।
ডেকের ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঢেউভাঙা পানি। আমার জুতো ভিজিয়ে দিল।
দুহাতে রেলিং চেপে ধরে বাঁচাও! বাঁচাও! বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। বাতাসের গর্জনে চাপা পড়ল আমার চিৎকার।
আরেকটা কালো পানির ঢেউ ভাঙল জাহাজের গায়ে। প্রাণপণে রেলিং আঁকড়ে রেখেছি। চেঁচিয়ে চলেছি একনাগাড়ে। আরও একটা ঢেউ ভাঙল ঠিক আমার সামনে।
পানি বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। নাকেমুখে ঢুকে গিয়ে খকখক করে কেশে উঠলাম।
পানি ভীষণ ঠাণ্ডা। আর কেমন ভারি ভারি। মনে হলো অন্ধকারের তলায় চাপা পড়েছি। রেলিংটা উধাও। হাত ছুটে গেছে। ডেকটাও অদৃশ্য হলো।
ঢেউ আমাকে টেনে নিয়ে চলল খোলা সাগরের দিকে। যেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে কালো পানি, তাণ্ডবনৃত্য জুড়েছে।
চোদ্দ
চেঁচাতে চাইলাম। স্বর বেরোচ্ছে না আর।
সাঁতার কাটার চেষ্টা করলাম। হাত-পা অসাড়।
ঢেউ আমাকে উঁচু করে তুলে রেলিঙের ওপর দিয়ে সাগরে টেনে নিতে চাইছে।
হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজলাম। অন্ধকার ঢেউয়ের হাতে সঁপে দিলাম নিজেকে।
কীসে যেন টেনে ধরল আমাকে। অক্টোপাসের কথা মনে পড়ল! আমার গোড়ালি চেপে ধরেছে!
টানছে আমাকে। ঢেউয়ের প্রচণ্ড টানের সঙ্গে লড়াই করে আমাকে আটকে রাখতে চাইছে।
ধীরে ধীরে টেনে সরিয়ে নিতে লাগল আমাকে।
আবার কাশলাম। মুখ থেকে নোনা পানি ছিটালাম। ডেকে মুখ ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছি।
থরথর করে কাঁপছি ঠাণ্ডা আর আতঙ্কে।
ঘন ঘন দম নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইলাম। গড়িয়ে চিত হলাম। কে আমাকে বাঁচিয়েছে দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ কি!
কেমন আছো? হাঁটু গেড়ে বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে হিউগ রেন।
আ-আপনি বেরোলেন কীভাবে? জিজ্ঞেস করলাম।
হাতকড়াটা ঠিকমত লাগেনি। খুলে ফেললাম। বদ্ধ জায়গায় দম নিতে পারছিলাম না। তাই খোলা হাওয়ায় বেরিয়েছি। চশমা খুলে
ভেজা কাপড়ে মুছতে লাগল রেন। চশমা ছাড়া কিছু দেখি না।
আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন! তোমার ভাগ্য ভাল, ঢেউ যখন তোমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় আমি চলে এসেছিলাম, রেন বলল। পা চেপে ধরলাম। টানাটানিতে একবার তো মনে হচ্ছিল আমাকে সুদ্ধ নিয়ে যাবে। সময়মত জাহাজটা অন্যপাশে কাত হয়ে গেল, তাই বাঁচলাম।
অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোক মায়ানেকড়ে হয় কীভাবে? বনে থাকতেও বিশ্বাস হয়নি, এখন তো আরও হচ্ছে না।
ওর বিষণ্ণ চোখ দুটোর দিকে তাকালাম। মায়ানেকড়ের চোখের সঙ্গে কোন মিলই নেই। চশমা ছাড়া দেখতেও পায় না। ওকে ধরে ভুল করেছে বাবা…
রবিন, তোমার কী হয়েছে? আমার দিকে ছুটে এল বাবা। রেনকে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠল, আরে, তুমি! ছুটলে কী করে? খপ করে তার হাত চেপে ধরল।
বাবা, ওকে ছেড়ে দাও, আমি বললাম। ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
ও ভয়ানক বিপজ্জনক! বাবা বলল। ওর কাছাকাছি থাকাও ঠিক না তোমার।
কিন্তু বাবা, বললাম তো ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। ঢেউ আমাকে, টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ও টেনে না ধরলে এতক্ষণে সাগরে হারিয়ে যেতাম। তাকিয়ে দেখো এখন? সত্যিই কী ওকে খারাপ মনে হয়?
মায়ানেকড়ে যখন মানুষের রূপে থাকে, তখন কিছুই বোঝা যায় না, রবিন, বাবা বলল। তুমি এখন যেমন আছে, ঠিক তেমনই দেখাবে তোমাকেও যদি মায়ানেকড়ে হয়ে যাও। আমি বলে দিচ্ছি, ওর ব্যাপারে সাবধান না হলে ভয়ানক বিপদে পড়বে। মনে রেখো কথাটা।