- বইয়ের নামঃ আবার মায়ানেকড়ে
- লেখকের নামঃ শামসুদ্দীন নওয়াব
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
আবার মায়ানেকড়ে
এক
এখন মধ্যরাত।
বনের ভিতরে হেঁটে চলেছি আমি আর বাবা।
রবিন, আস্তে, এত শব্দ কোরো না! বাবা বলল। ওরা শুনে। ফেলবে তো!
আমিও শব্দ না করেই চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু বনতলে শুকনো। ঝরা পাতা এড়িয়ে চলা খুব কঠিন। পা পড়বেই, আর পড়লেই শব্দ হয়।
আমি রবিন, রবিন মিলফোর্ড। হাই স্কুলে পড়ি। গ্রীনহিলসে থাকি।
আমার বাবার নাম রজার মিলফোর্ড। সাংবাদিক। মোটামুটি প্রভাবশালী লোক।
মাঝে মাঝেই নানা উদ্ভট খেয়াল চাপে বাবার মাথায়। এই যে, এবার যেমন মায়ানেকড়ে চেপেছে ঘাড়ে। ধরার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আর তাই, ব্র্যাটভিয়ায় মায়ানেকড়ে আছে খবর পেয়ে এক মুহূর্তও দেরি করেনি, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি পেয়েছি। ভেবেছিলাম গ্রামের বাড়িতে দাদুর কাছে বেড়াতে যাব। কিন্তু বাবা আমাকে ধরে নিয়ে। এসেছে ব্র্যাটভিয়ায়। আমার আসার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। মায়ানেকড়েতে আর আমার কোন আগ্রহ নেই, বরং ভয় পাই। ওগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকতে পারলে খুশি হই। কিন্তু কী আর করা। বাবা নিয়ে এসেছে।
গাছের ডালপালা কাঁপিয়ে বয়ে গেল ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা বাতাস। কেঁপে উঠলাম।
গাছপালাগুলো অতিরিক্ত ঘন এখানে। গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করে আছে। মায়ানেকড়ে লুকানোর উপযুক্ত জায়গা। সাবধান না হলে যে কোন মুহূর্তে আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসে ঘাড়ে পড়বে। তারপর ধারাল দাঁত আর নখ দিয়ে কীভাবে আমার দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করবে, কল্পনা করে শিউরে উঠলাম।
মায়ানেকড়ে বড় ভয়ঙ্কর! অভিশপ্ত এদের জীবন। দিনে সাধারণ। মানুষ থাকে, স্বাভাবিক কাজকর্ম করে, রাতে হয়ে ওঠে রক্তলোলুপ পিশাচ। লোকে বলে, ভাল মানুষকে মায়ানেকড়েতে কামড়ালে নাকি সেই মানুষটাও মায়ানেকড়ে হয়ে যায়। পূর্ণিমার আগে শুরু হয় এদের উৎপাত। কারও কারও মতে, পূর্ণিমার রাতসহ আগের দুরাতে চাঁদ উঠলে মানুষ থেকে এরা মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হয়। বেরিয়ে পড়ে তাজা মাংসের সন্ধানে। সারারাত শিকার ধরে বেড়ায়। ভোরের আলো ফুটলে আবার মানুষ হয়ে যায়। তার আগেই কেউ যদি ওটার নাম ধরে ডাকে, কিংবা মাথায় তিনবার চাপড় দেয়, তাহলেও নাকি মানুষ হয়ে যায়।
মুখ তুলে তাকালাম আকাশের দিকে। গোল চাঁদটা কেমন ঝুলে রয়েছে। জ্যোৎস্নার রূপালী আলো যেন ধুয়ে দিচ্ছে গাছগুলোর মাথা। ভূতুড়ে পরিবেশ বনের ভিতরে। বাবার ধারণা, এই পরিবেশে। মায়ানেকড়ে বেরোবেই। তাজা মাংসের জন্য জানোয়ার শিকার করবে। বাগে পেলে মানুষকেও ছাড়বে না।
ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল আমার। দাঁড়িয়ে গেলাম। বাতাসে ভেসে আসছে নানারকম বুনো জানোয়ারের ডাক। বিলাপের মত আর্তনাদ কোনওটার। কোনওটা চাপা কুঁই কুঁই করছে। কোনওটা আবার ভয়ানক গর্জনে বন কাঁপাচ্ছে।
রবিন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বাবা বলল। ওভাবে থাকলে তো ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে।
ঝট করে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মাথার ওপর বড় কোনও ডাল আছে কিনা, আর সে-ডালে মায়মায়ানেকড়ে ঘাপটি মেরে আছে কিনা।
তারপর মরা পাতা এড়িয়ে বাবার পিছন পিছন যতটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোনোর চেষ্টা করলাম।
দ্রুত এগোচ্ছে বাবা।
বাবা, আস্তে! তোমার সঙ্গে হেঁটে পারছি না তো! কিন্তু গতি কমাল না বাবা। রীতিমত দৌড়াচ্ছে।
বাবা, প্লিজ! চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিলাম বাবার পিছন পিছন।
আশ্চর্য। হঠাৎ কী হলো বাবার? আমি বলা সত্ত্বেও আমার জন্য। অপেক্ষা করছে না। গতিও কমাচ্ছে না।
বাবা! দাঁড়াও! আমি আর পারছি না! হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম।
পা ব্যথা করছে আমার। একটা গাছের শিকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। খসখসে বাকলে ঘষা লেগে গাল কেটে রক্ত বেরিয়ে এল।
কোনমতে উঠে আবার দৌড়ানো শুরু করলাম।
কিন্তু আমি যত দৌড়াই, বাবা তারচেয়েও জোরে ছোটে। আমাকে কাছে যেতে দেয় না। এটা কী রকম হচ্ছে! এমন করছে কেন?
বাবা! আবার ডেকে বললাম, থামো! দাঁড়াও!
অবশেষে থামল বাবা। ঘুরে তাকাল আমার দিকে। চিৎকার করে উঠলাম। আতঙ্কে।
দুই
বাবার মুখে বড় বড় লোম গজাচ্ছে। মানুষের মুখ বদলে গিয়ে নেকড়ের আদল তৈরি হচ্ছে। মায়ানেকড়ে হয়ে যাচ্ছে বাবা!
আমার দিকে তাকিয়ে জিভ চাটল। বড় বড় দাঁত দেখলাম। এখনও দুই পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মত দাঁড়িয়ে আছে ভূতুড়ে প্রাণীটা। মাথা হেলিয়ে মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল।
চিৎকার করতে চাইলাম। স্বর বেরোল না। দৌড় দিতে চাইলাম। পা কথা শুনল না।
সারা গা লোমে ভরে গেল প্রাণীটার। হাত দুটোও রূপান্তরিত হলো। পায়ে।
চারপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল ওটা। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তারপর গর্জন করে উঠল। আত্মা কাঁপিয়ে দিল আমার।
স্বপ্ন! স্বপ্ন! নিজেকে বললাম। দুঃস্বপ্ন দেখছি আমি!
আর স্বপ্নের কথা ভাবতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। এত ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘেমে গেছি। কাত হয়ে শুলাম। একটা তাঁবুতে রয়েছি আমি। ক্যাম্প খাটে শোয়া। হঠাৎ আঁচড়ের শব্দ কানে এল। তবু কাটার চেষ্টা করছে যেন কোন জানোয়ার। তাঁবুতে ঢুকতে চায় নাকি? আবার কী ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি? দম আটকে ফেললাম। আঁচড়ের শব্দ বাড়ছে। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। হাতে চিমটি কাটলাম। ব্যথা লাগল। কই, স্বপ্ন তো দেখছি না! জেগেই রয়েছি! আগেরটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এটা একদম বাস্তব! ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ডটা। আঁচড়ের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বুকের কাঁপুনিও বেড়ে যাচ্ছে।
তিন
আর থাকতে না পেরে, কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলাম। শার্ট-প্যান্ট পরাই আছে। পায়ে মোজা। অন্ধকারে হাতড়ে ক্যাম্প, খাটের পাশে মাটিতে রাখা জুতো জোড়া বের করে পরলাম।