মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে মুসার কপালে হাত রেখে বললেন, কই, জ্বর-টর তো নেই দেখছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও দেখি। আজ তোমার বাবা তোমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।
কে আমার বাবা! বলল হতভম্ব মুসা। আমার বাবা-মাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আপনারা?
কী আবোল-তাবোল বকছ? বিরক্ত গলায় বললেন ভদ্রলোক। লুকিয়ে রেখেছি মানে?
আপনাদের তো চিনি না আমি! আপনারা..
চুপ করো! ধমক লাগালেন এবার মহিলা। এ সব কী বলছ তুমি? দেরি করে স্কুলে গেলে বকা খেতে হবে, সে খেয়াল আছে?
এমন সময় একটা বেড়াল ঢুকল রান্নাঘরে। জীবনে ওটাকে এই প্রথম দেখল মুসা। এগিয়ে এসে আহ্লাদী ভঙ্গিতে ওর পায়ের সঙ্গে গা ঘষতে লাগল বেড়ালটা।
ছোটখাট এক লাফ দিয়ে সরে গেল মুসা। এটা আবার কোত্থেকে আমদানী হলো? পুশি কোথায়, পুশি?
পুশি? অবাক হলেন মহিলা। পুশি কে? দেখো মুসা, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
ভয় পেয়ে গেল মুসা। এসব কী ঘটছে ওদের বাড়িতে? মাথার মধ্যে কেমন যেন করছে। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। দুপা অবশ হয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ওর।
ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল ও। কোনওমতে বলল, আপনারাই আমার বাবা-মা, এ কথা বলতে চান? শেষদিকে গলা কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠল ওর।
ঝুঁকে ওর মাথায় একটা চুমু খেলেন ভদ্রমহিলা। বলতে চাওয়ার দরকার কী? তাই তো সত্যি। আমি তোমার মা, ইনি বাবা। ওটা তোমার বেড়াল-মাস্টার।
আমার কোনও বোন নেই? মামাত?
না, বললেন বাবা। তুমি আমাদের একমাত্র ছেলে।
তোমার যদি বোন থাকত, প্রশ্রয়ের সুরে বললেন মা। তোমার সবকিছুতে ভাগ বসাত। সেটা কী ভাল হত?
খেপে উঠল মুসা। থা-থা-থামুন! উত্তেজনায় খানিক তোতলাল।
অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়েছেন আপনারা আমাকে। আর নয়। এবার বলুন আমার আসল বাবা-মা কোথায়? এসব কী ঘটছে? আমাদের বাড়িতে আপনারা কেন?
ওর মা-বাবা নজর বিনিময় করলেন। তারপর একযোগে তাকালেন ওর দিকে। হতবিহ্বল চাউনি।
মা বলছেন না কেন আপনারা কারা! ধৈর্য হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
আমার আসল পরিবারের অন্য সবাই কোথায়?
বাবা উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত চেপে ধরলেন। শার্ট ভেদ করে তার নখ মাংসে গেঁথে যাওয়ার জোগাড় হলো। জলদি চলো। আর সময় নেই। চড়া। গলায় আদেশ দিলেন।
না! কাতরে উঠল মুসা। ব্যথা পেয়েছে। যাব না আমি!
সকাল হতে না হতে অনেক উঁচড়ে পাকামো করে ফেলেছ। চলো এখন!
কিছু করার নেই মুসার। বাবার টান খেয়ে এগোতে হলো। গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল। দেখল ওদের পুরানো মডেলের টয়োটা করোলার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঝঝকে নতুন একটা ফিয়াট। ১. ধমক খেয়ে গাড়িতে উঠে বসল মুসা। এমনসময় বেরিয়ে এলেন মহিলা। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন গাড়ির দিকে। আজ তোমার হয়েছে কী, মুসা, বলো তো! বই-টিফিন, পানি ছাড়াই স্কুলে যাচ্ছ যে বড়, খোলা জানালা দিয়ে ওগুলো এগিয়ে দিলেন। ধরো এগুলো। তারপর আদর করে ওর নাক টিপে দিলেন।
ধ্যাৎ! বিরক্ত হলো ও। কী করছেন! ওর মা কখনও এই কাজ করেন না। কাজেই এসবে অভ্যস্ত নয় মুসা।
গাড়ি স্টার্ট দিলেন নকল বাবা। মাথা দুলিয়ে দ্বিতীয় মা বললেন, দেখো, স্কুলে কারও সাথে মারামারি বাধিয়ে বোসো না যেন কালকের মত।
ওঁরা সিরিয়াস, বুঝতে পেরে অদ্ভুত অনুভূতি হলো মুসার। অভিনয় করছেন না তারা। সত্যি সত্যি ভাবছেন যে তারাই মুসার মা-বাবা। ওঁদের। আসল ছেলেটা গেল কোথায়? তার নামও মুসা?
কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
কী আশ্চর্য!
সারা শরীরে কাপ ধরে গেল মুসার।
এসবের মানে কী?
১০
পরশু ও ছিল তেরো বছরের কিশোর। গতকাল হঠাৎ করে বয়স বেড়ে হয়ে গেল।
তারপর আজ… আজ আবার বয়স তেরোয় নেমে এসেছে, তবে পরিবার বদলে গেছে। অন্য এক পরিবারের সদস্য আজ মুসা। ও কি স্বপ্ন দেখছে আসলে?
গাড়ি চালাচ্ছেন সেই পরিবারের প্রধান, ওর নতুন বাবা। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে মুসা।
আমরা কোথায় যাচ্ছি? দুর্বল গলায় জানতে চাইল।
তোমার স্কুলে, জবাব দিলেন তিনি। মুহূর্তের জন্য পাশে তাকালেন। কেন, তোমার কী মনে হয় আমরা হাওয়া খেতে বেরিয়েছি?
কিন্তু এটা তো আমার স্কুলের রাস্তা নয়।
চরম বিরক্তি নিয়ে মাথা এপাশ-ওপাশ করলেন মানুষটা। বোঝাই যায়। মুসার উপর ক্রমে চটে উঠছেন। পরিস্থিতি অসহ্য করে তুলেছে ও।
একটা স্কুলের সামনে থেমে দাঁড়াল গাড়ি। কিন্তু ওটা মুসার স্কুল নয়। এটা ওদের স্কুলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রকি বিচ কুইন্স হাইস্কুল। ওর সম্পূর্ণ অচেনা।
এসে গেছি। নেমে পড়ো এবার, হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিলেন তিনি।
আস্তে করে নেমে পড়ল মুসা। কী করবে মাথায় খেলছে না।
যাও, স্কুলে যাও। আমি চললাম।
চলে গেলেন বাবা।
এখন? ভাবল ও। এখন কী করব?
বয়স নিয়ে আপাতত কোনও সমস্যা না থাকলেও অন্য এক পরিবারের ছেলে হয়ে গেছে ও। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্কুলের ছাত্র।
এমন আজগুবি কথা কেউ শুনেছে কখনও?
ও কি জেগে আছে, না ঘুমিয়ে? দুঃস্বপ্ন দেখছে?
কানের লতিতে চিমটি কাটল জোরে। কই, না, ব্যথা লাগে তো! সামনে বড় এক পাথরের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে আরও নিশ্চিত হতে লাথি ঝেড়ে বসল। উফ! ব্যথা লেগেছে।
তার মানে ও জেগে আছে। এসব দুঃস্বপ্ন নয়, সত্যি।