আমি কিছু মনে করিনি, বলল মেয়েটা হাসতে হাসতে। বই-খাতা তুলে উঠে দাঁড়াল ওরা।
আমার নাম সানজানা।
আমি মুসা।
তোমার কী হয়েছে, মুসা? ওকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করতে করতে বলল সানজানা। তাড়া আছে বুঝি খুব?
কী বলার আছে মুসার! এর মধ্যে ওর উপর দিয়ে কত ধকল গেছে, কীভাবে বোঝাবে ওকে?
আমাকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়তে হবে, জবাব দিল ও। তারপর শুধরে নিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। পরে আবার দেখা হবে।
হন-হন করে হাঁটতে শুরু করল মুসা। প্রিন্সিপাল সার যদি জানতে পারেন ও কলেজ থেকে ভেগেছে, তা হলে সাড়ে সর্বনাশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়া উচিত।
বাসায় ফিরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। আপাতত ঝামেলার হাত থেকে বাঁচা গেছে ভেবে খুশি।
ড্রইং রুমে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সোফার উপর।
ওহ, কী একটা দিন গেল রে বাবা! ভাবল মনে মনে। এমন দিন যেন কারও জীবনে কখনও না আসে।
কলেজের ওই বিশালদেহী রহস্যময় ছেলেটার কথা মনে হতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠল মুসা। বিশাল থাবা ছেলেটার, একটা ঘুসি যদি মুখের উপর পড়ত, দ্বিতীয়টা পড়ার জায়গা থাকত না।
আজ মোটামুটি নিরাপদেই বাসায় ফেরা গেছে।
কিন্তু কাল?
কাল কী হবে?
.
তানজিয়া আর শাওনি স্কুল থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত টিভি দেখে কাটাল মুসা।
ওরা এখন পিচ্চি। মুসাকে দেখাশোনা করবে কী, উল্টে মুসারই ওদেরকে দেখেশুনে রাখতে হবে।
আনা কারেনিনায় একটু নজর বোলাতে হয়। কারণ ক্লাস ভর্তি ছাত্র ছাত্রীর সামনে আর বেইজ্জত হতে চায় না ও। কিন্তু যে সমস্ত খটমটে নাম, বাবা! পড়তে গেলে মাথা ব-বন্ করে। উচ্চারণ করতে গেলে দাঁত খসে পড়ার অবস্থা হয়।
কলেজের কথা মনে হতেই চোখের সামনে বিশালদেহী ছেলেটার চেহারা, ভেসে উঠল। কাল ওকে কীভাবে সামাল দেবে ও?
সাহায্যের জন্য কিশোরের কাছে যাবে কি না ভাবল একবার। পর মুহূর্তে চিন্তাটা বাতিল করে দিল। বিপদটা ওর, অযথা আরেকজনকে জড়াতে যাওয়া কেন? একাই এ বিপদের মোকাবিলা করবে ও, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মুসা।
.
রাত হলো। ঘুমাতে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল। নিজের রুমে এসে দেখল তানজিয়া ঘুমাচ্ছে ওর বিছানায়।
সুতরাং ধীর পায়ে গেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে চলল মুসা। নিঃশব্দে ঢুকে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল।
এই বিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার পাব আমি? ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করল ও। এসব কী ঘটছে জানা নেই। কেন ঘটছে, জানে না।
কী করা উচিত, বুঝতে পারছে না।
কীভাবে আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে ও?
৮
চোখ মেলল মুসা। খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে মুখের উপর। সকাল হয়ে গেছে।
সবার আগে কলেজের কথা মনে পড়ল ওর। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা শুকিয়ে উঠল। আবার চোখ বুজল। মরে গেলেও আর কলেজে যাচ্ছি না ভাবল মনে মনে। কিছুতেই না। কেন যেন বিছানায় শুয়ে থাকাই সবচেয়ে : নিরাপদ বলে মনে হলো। যেন তাতেই সব সমস্যার হিল্লে হয়ে যাবে।
মুসা! মার ডাক ভেসে এল। জলদি ওঠো! এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় নাকি কেউ!
উঠতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুক্ষণ পড়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।
মুসা!
এবার মার কণ্ঠ কেমন যেন অন্যরকম ঠেকল ওর কানে। এত জোরে চেঁচান না কখনও উনি। ব্যাপার কী?
লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল মুসা। পা ঝুলিয়ে দিল।
দাঁড়াও, দাঁড়াও।
এ কী!
তীক্ষ্ণ চোখে পায়ের দিকে তাকাল মুসা। অন্যরকম লাগছে না? আগের মত মনে হচ্ছে না?
হ্যাঁ, তাই তো! আগের পা ফিরে পেয়েছে মুসা!
তার মানে… তার মানে আমি আবার আগের দেহ ফিরে পেয়েছি, ভাবল ও। তেরো বছর বয়সে ফিরে গেছি!
চোখের সামনে দুহাত তুলে ধরল। ছোট হাত। আর যাই হোক, এ হাত ষোলো বছরের কোনও ছেলের হাত হতে পারে না।
মুসা আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছে। কোনও ভুল নেই তাতে।
গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমে ঢুকল ও। আয়নার সামনে দাঁড়াল।
জলদি এসে নাস্তা সেরে নাও! তাড়া লাগালেন মা।
কানে ঢুকল না। নিজেকে দেখায় মগ্ন।
হ্যাঁ, ওই তো সেই মুসা, দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। তেরো বছরের মুসা।
ইয়াহ্ হু! চাপা আনন্দে ফেটে পড়ল ও। খুশিতে এমন এক লাফ দিল যে আরেকটু হলে বাথরুমের ছাদে ঠুকে যেত মাথা।
সব সমস্যার হিল্লে হয়ে গেছে। ওকে আর কলেজে যেতে হবে না আজ! ওই ব্যাটা নচ্ছার ভালুকের মুখোমুখিও হতে হবে না। কী মজা!
দুঃস্বপ্নের পালা শেষ হয়েছে তা হলে। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে। এসেছে ও। সব ঠিক হয়ে গেছে।
মুসা, দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু, মার ডাকে সংবিৎ ফিরল ওর।
কিন্তু তার কণ্ঠ অন্যরকম লাগছে কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে? ভাবল ও। ঘরে এসে স্কুল ড্রেস পরে তাড়াতাড়ি কিচেনের দিকে এগোল মুসা।
ঝড়ের বেগে কিচেনে ঢুকল। মা, আজ কিন্তু আমি…
সামনের দৃশ্য দেখে গলায় কথা আটকে গেল ওর। কিচেন টেবিলে বসে আছেন দুই অপরিচিত মানুষ। একজন মহিলা, একজন পুরুষ। জীবনে কখনও দেখেনি মুসা ওঁদের।
৯
হাঁ করে কী দেখছ? বললেন মহিলা। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে নাও। স্কুলে যেতে হবে না?
আমার মা-বাবা কোথায়? অনিশ্চিত গলায় বলল মুসা। চোখদুটো। এখনও রসগোল্লার মত হয়ে আছে। ফারিহা, শাওনি ভাই, তানজিয়া?
দৃষ্টি বিনিময় করলেন দুজন।
শরীর খারাপ করেছে নাকি, সান? বললেন পুরুষ লোকটা।
সান? মানে ছেলে? মুসা কেন তাঁর ছেলে হতে যাবে?