কয়েকবার জোরে জোরে দম নিল মুসা। উজবুকের মত চেয়ে আছে সারের দিকে। কেন এসেছে, ভয়ে, উত্তেজনায় সব গুলে খেয়ে হজমও করে ফেলেছে।
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ফার্স্ট ইয়ার।
ইয়ে… সার… আমতা আমতা করতে লাগল মুসা। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
বসো, মুসা, সামনের চেয়ার দেখিয়ে শান্ত স্বরে বললেন সার। ভয় একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। প্রিন্সিপালকে যতটা কড়া ভেবেছিল, দেখা যাচ্ছে ততটা নন। এখন বলো কী হয়েছে।
কোথাও বড় ধরনের কোনও গণ্ডগোল হয়ে গেছে, সার, শুরু করল মুসা। তারপর হড়বড় করে বলে ফেলল, এই মুহূর্তে এখানে আমার থাকার কথা নয়। আমি কলেজের ছাত্র নই, সার।
একটু একটু করে ভ্রূ কুঁচকে উঠল প্রিন্সিপালের। মানে! তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি, মুসা।
সার, আমি স্কুলের ছাত্র, গলা দিয়ে আপনাআপনি কান্নার মত একটা আওয়াজ ঠেলে বেরিয়ে এল মুসার। আমি ক্লাস এইটে পড়ি। কলেজের ছাত্র নই।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ওর দিকে চেয়ে রইলেন প্রিন্সিপাল। চেহারায় অস্বস্তি। উঠে হাত বাড়িয়ে মুসার কপাল ছুঁয়ে দেখলেন তিনি।
মুসা বুঝতে পারল ওর জ্বর উঠেছে কি না তাই চেক করছেন সার। ওর কথা নিশ্চয় পাগলের প্রলাপ ভাবছেন উনি।
তাই হবে। নইলে কপাল ছুঁয়ে দেখবেন কেন?
হাসির ভঙ্গি করলেন প্রিন্সিপাল। শান্ত, নরম স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, মুসা, এই কলেজেরই ছাত্র তুমি। আমার কথা বোঝা গেছে? কে বলল তুমি ক্লাস এইটে পড়ো?
আমি… আমি জানি আমাকে দেখে কলেজের ছাত্র বলেই মনে হয়, আমতা আমতা করে বলল ও। কিন্তু আসলে আমি স্কুলের ছাত্র। একটু আগে ইংলিশ ক্লাসে সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। প্রথম শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে আমার দাঁত ভাঙার জোগাড় হয়েছিল। আমি সত্যি…
শান্ত হও, মুসা, ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন প্রিন্সিপাল। তুমি ভুল করছ। একটা ফাইল বের করে খুলে ধরলেন। ঝুঁকে তীক্ষ্ণ চোখে ওটা দেখল মুসা। ছাত্র-ছাত্রীদের নামের তালিকা ওটা। দেখো, চেয়ে দেখো।
সবার উপরে নিজের নামটা দেখে চোখ আলু হয়ে উঠল মুসার। এ কী করে সম্ভব! ও স্বপ্ন দেখছে না তো?
চোখ বুজল। লম্বা করে দম নিয়ে তাকাল।
নাহ্, স্বপ্ন নয়। যা ঘটছে সব সত্যি। কঠোর বাস্তব।
দেখলে? হাসলেন প্রিন্সিপাল। কলেজেরই ছাত্র তুমি, মুসা। ফাঁকিবাজও নও, তোমার রেজাল্ট অন্তত তা-ই বলে। এখন বলল, কেন তুমি পড়া দেখে ভয় পাচ্ছ?
কিন্তু… কিন্তু… আগে আমি কখনও কলেজের পড়া… প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল মুসা।
কী ঘটছে এসব? এসবের মানে কী?
একলাফে কয়েকটা বছর বয়স বেড়ে গেল কীভাবে? মাঝখানের বছরগুলো কোথায় গেল? কেন মনে করতে পারছে না ও?
আপনি বুঝতে পারছেন না, সার, মরিয়া হয়ে বলল মুসা। কাল আমার বয়স ছিল তেরো। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর দেখি আমার বয়স অনেক! আমার দেহ বড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনের বয়স বাড়েনি, তেরোই রয়ে গেছে!
আমি জানি, জবাব দিলেন প্রিন্সিপাল।
৬
আমি জানি তুমি গোয়েন্দাগিরি করতে ভালবাসো, বলে চলেছেন উনি। কিন্তু তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো তুমি?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সার। মুসার বুঝতে বাকি রইল না বিরক্ত হচ্ছেন উনি। একটু একটু করে রেগেও উঠছেন।
পদার্থবিদ্যার ক্লাস শুরু হবে, বললেন সার। এখন ক্লাসে যাও।
জ্বি?
ফিজিক্সের ক্লাস শুরু হবে, আবারও বললেন সার, এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট কোরো না, যাও!
কিন্তু, সার, আমি কিছুই বানিয়ে বলিনি, যা বলেছি, সত্যি বলেছি।
আর একটা কথাও নয়, উঠে দাঁড়ালেন প্রিন্সিপাল। থমথমে গলা। যাও, ক্লাসে যাও।
নিরুপায় হয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। ধীর পায়ে বেরিয়ে এল প্রিন্সিপালের অফিস থেকে। সেই বিশাল ছেলেটার খোঁজে চারদিকে তাকাল ভয়ে ভয়ে।
নেই। আশপাশে কোথাও নেই ও। করিডর ফাঁকা।
এই নরক থেকে পালাতে হবে, ভাবল মুসা। যেভাবে হোক পালাতে হবে। ক্লাসের দিকে না গিয়ে হনহন করে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল ও।
গেটের কাছাকাছি এসে কেউ ওকে ফলো করছে কি না বুঝবার জন্য পিছনে তাকাল। নাহ্, কেউ নেই।
কিন্তু গেট দিয়ে বেরোতেই কারও সাথে ধাক্কা খেল জোরে।
৭
আরেকটু হলে মাটি শোকার ব্যবস্থা হয়েছিল আর কী! পড়তে পড়তে কোনও মতে সামলে নিল নিজেকে।
উহ্! নীরবে চেঁচিয়ে উঠল ওর অন্তরাত্মা।
পাশেই একটা মেয়েকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখা গেল। চারদিকে বই খাতা ছড়িয়ে আছে। মেয়েটার সাথেই ধাক্কা খেয়েছে ও, বুঝতে অসুবিধে হলো না।
লজ্জিত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল মুসা। তুমি ব্যথা পাওনি তো? মিমি করে বলল। আমি… আমি দুঃখিত।
নীরবে মাথা দোলাল মেয়েটা। না, ঠিক আছে। ভুল তো আমারও হয়েছে।
দুঃখিত, আবারও বলল মুসা। তোমাকে দেখতে পাইনি। দিনটা আমার ভীষণ বাজে যাচ্ছে আজ।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাসল মেয়েটা। আমি ব্যথা পাইনি।
মেয়েটার বয়স বারো-তেরোই হবে। মিষ্টি চেহারা। মাঝ পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে বেণী করে বাঁধা ঘন চুল। ধূসর চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা।
বই-খাতা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।
দাঁড়াও, আমি হেল্প করছি, বলে মেয়েটার পাশে বসে পড়ল মুসা। ঝুঁকতেই মাথার সাথে মাথা ঠুকে গেল দুজনের।
উহ! গুঙিয়ে উঠল মুসা। এই দেখো, আবার তোমাকে ব্যথা দিলাম। আসলে নিজেই ব্যথা পেয়েছে।