বই খুলল ও। নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বের করল। অজান্তে একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এল। পৃষ্ঠাটা বিশাল, কঠিন কঠিন সব শব্দ দিয়ে ভরা। ওগুলো পড়ে বোঝার চেয়ে সাঁতার কেটে সাগর পাড়ি দেয়াও অনেক সহজ হবে।
দাঁতভাঙা রাশান নাম-কীভাবে উচ্চারণ করবে মুসা? এক ক্লাস ছাত্র ছাত্রীর সামনে বেইজ্জত হতে চলেছে বুঝতে বাকি নেই ওর।
ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম বাক্যটা দেখে নড়াচড়া দূরে থাক, শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। হৃৎপিণ্ডের গতি থেমে পড়ার অবস্থা।
বিরাট বাক্য। শুধু বিশাল বললে কমই বলা হবে, বি-শা-ল। যেন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে শুরু হয়ে টেক্সাসে গিয়ে থেমেছে ওটা। এক বাক্যেই পুরো পৃষ্ঠা কাবার!
ওদিকে নীরবতার সাগরে ডুবে গেছে পুরো ক্লাস। একটা পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে।
ছাত্র-ছাত্রীরা হাঁ করে চেয়ে আছে মুসার দিকে। যেন চিড়িয়াখানার আজব কোনও জন্তু ও, খাঁচা ভেঙে পালিয়ে এসেছে। চোখেমুখে ওদের নীরব কৌতূহল।
চিন্তিত ভঙ্গিতে নীচের ঠোঁট মুখে পুরে চুষতে লাগল মুসা। কী করবে দিশে পাচ্ছে না। সারের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না লজ্জায়। পৃষ্ঠার শুরুতেই একটা বিরাট নাম আছে, ওটা উচ্চারণের সাধ্য ওর নেই!
মাথা নীচু করে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বইয়ের দিকে।
কী হলো! নড়েচড়ে বসলেন সার। চুপ করে আছ কেন, পড়ো!
লম্বা একটা দম নিয়ে শুরু করল মুসা, দ্য ইয়াং প্রিন্সেস কিটি শেরব্… শেরবা… শেরবি…
দাঁত ভাঙার অবস্থা হতে থেমে পড়ল বাধ্য হয়ে।
শেরবেট স্কায়া, শুদ্ধ করে দিলেন সার। হাসলেন। শেরবি নয়। নামটা আগের প্রত্যেকটা ক্লাসে বহুবার উচ্চারণ করা হয়েছে, মুসা। এতদিনে তোমার মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা।
কী কায়া? কি বললেন সার? উনি বলে দেয়ার পরও ওর দ্বারা বিদঘুঁটে শব্দটা উচ্চারণ করা সম্ভব হলো না। দেহটা আঠারো বছরের হলে কি হবে, ওর আসল বয়স তো তেরো। তেরো বছরের একটা ছেলের পক্ষে কি এত বিচ্ছিরি শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব? মোটেই না।
রয় মার্টিন, বইটা ওর কাছ থেকে নিয়ে তুমি পড়ো দেখি, মেজাজ খাট্টা করে আদেশ দিলেন সার।
তা-ই করল ছেলেটা, উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে পড়তে শুরু করল। গল্পটা বোঝার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু একটা শব্দও মাথায় ঢুকল না, এ ধরনের শব্দ জীবনে শোনেইনি, বুঝবে কী করে?
ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ওর। অজান্তে হাই তুলল একটা।
বিরক্ত লাগছে নাকি, মুসা? প্রশ্ন করলেন সার। ব্যাপারটা দূর করে দিচ্ছি, দাঁড়াও। রয় মার্টিন, থামো। থামল ও। মুসা, ও যেটুকু পড়ল, এবার তুমি তার অর্থ বলো।
অর্থ! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল, মুসা। একি অনর্থ কাণ্ড! অর্থাৎ ঘটনা খুলে বলতে হবে?
হ্যাঁ, উপর-নীচে মাথা দোলালেন সার।
নীরবে কয়েকটা মুহূর্ত কাটিয়ে দিল মুসা।
কখন ক্লাস শেষ হবে? ভাবছে মনে মনে।
অর্থ? এবার বিড়বিড় করে নিজেকে শোনাল। কুঁচকে উঠল, এমন ভঙ্গি করল, যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। ইয়ে… মানে…সার…
ক্লাসের সবগুলো চোখ মুসার উপর স্থির। গিলছে ওকে। কয়েকটা ছেলে মজা পেয়ে হাসছে নীরবে।
অধৈর্য হয়ে উঠলেন সার। কী হলো, বলো! খালি বল খেলে বেড়ালেই চলবে? পড়াশোনা করতে হবে না?
কী করা উচিত মুসার? কী-ই বা করার আছে। একটা বর্ণও তো বুঝতে পারেনি, কী ঘোড়ার ডিম বলবে? ক্লাস থেকে পালানোর ফিকিরে আছে। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।
ইয়ে… সার, আমার খুব বাথরুম পেয়েছে।
চাপা হাসির রোল পড়ল। সারের ঠোঁটে এক টুকরো হাসির আভাস ফুটে উঠতে না উঠতে মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে উঠলেন।
যাও, বললেন উনি। তাড়াতাড়ি এসো।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
আপাতত এই বিপদ থেকে তো উদ্ধার পাওয়া গেছে, ভেবে ও খুশি।
ত্রস্ত পায়ে করিডর ধরে এগিয়ে চলল মুসা। একশো মাইল বেগে দুইশো রকমের চিন্তা বয়ে যাচ্ছে মাথায়। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে সামনে এগোচ্ছে ও। একটা দরজার সামনে এসে ব্রেক কষল। উপরে লেখা: রিচার্ড স্যালন, প্রিন্সিপাল।
কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেতরে ঢুকব? ভাবল মুসা। প্রিন্সিপাল সারকে খুলে বলব সব?
কিন্তু ভিতরে যাওয়া কি উচিত হবে? নতুন কোনও সমস্যা যদি তৈরি হয়? তখন কী হবে!
নাহ্, ঢুকব না। ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল ও, এমন সময় ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল কেউ তেড়ে আসছে ওর দিকে। এমন কেউ, যাকে মোটেই আশা করেনি ও।
ও… তুমি তা হলে এখানে? সেই বিশালদেহী ছেলেটার গলা শুনে আঁতকে উঠল মুসা। আর দেরি করতে পারছি না। চলো! ওইদিকটায় চলো! হাত বাড়াল কলার চেপে ধরবে বলে।
৫
হঠাৎ করে প্রিন্সিপালের অফিসটাকে এ-মুহূর্তে নিরাপদ জায়গা বলে মনে হলো মুসার। এই ধেড়ে ছোঁড়া যে-ই হোক না কেন, প্রিন্সিপালের অফিসে ঢুকে ওকে ধোলাই দেয়ার সাহস পাবে না।
আমার কাজ শেষ হওয়ার পর, মারফতি হাসি ফুটল ছেলেটার মুখে, তোমাকে আর চেনা যাবে না। হাঃ হাঃ হাঃ।
চট করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল মুসা। ডেস্কের পিছনে হ্যাংলা পাতলা এক লোককে বসে থাকতে দেখা গেল। মাথা জুড়ে চকচকে টাক। নাকের নীচে বাহারি গোঁফ। ঘরে আর কেউ নেই। কুতকুতে চোখ তুলে ওর দিকে তাকালেন প্রিন্সিপাল।
কে? ও তুমি? বললেন গমগমে কণ্ঠে। এত শুকনো লোকের গলা এমন মোটা হতে পারে, ভাবাই যায় না। কোন ইয়ারের ছাত্র যেন?