ঘুরে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বিশাল কলেজ বিল্ডিংটার দিকে তাকাল ও। গলা-বুক শুকিয়ে সাহারা মরুভূমি।
কপালে আজ কী আছে আল্লা মালুম।
৪
ঘণ্টার আওয়াজ কানে আসতেচমকে উঠল ও। বড় বড় ছেলে-মেয়েরা দ্রুত ক্লাসরুমে ঢুকে যাচ্ছে।
অ্যাই ছেলে, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? পিছন থেকে এক টিচারের ডাকে আতঙ্কে লাফিয়ে উঠল মুসা। ক্লাসে যাও! ঘণ্টা পড়ে গেছে শুনতে পাও না? বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেলেন উনি।
স্কুলের প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। সেই দিন আর আজকের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আজও সেদিনের মতই নিজেকে অসহায়-এতিম মনে হলো।
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু লজ্জায়, তা-ও পারছে না। এতবড় ধাড়ি ছেলে কলেজের ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে চেঁচালে মান-ইজ্জত থাকবে নাকি?
এইটুথ গ্রেডের ছাত্র মুসা। স্কুল পাস করতে এখনও বেশ কয়েকবছর বাকি। তারপর না কলেজ!
অথচ…
এখন কী করব আমি? ভাবল মুসা। কী করা উচিত আমার? কোথায় যাব? কোন ক্লাসে ঢুকব? ফার্স্ট ইয়ারে নাকি সেকেণ্ড–কোন ক্লাসের ছাত্র আমি, সেটাও তো জানি না।
বিশাল দেহের একটা ছেলে গটগট করে ওর দিকে এগিয়ে এল। সামনে এসে ঝুঁকে ওর মুখের দিকে তাকাল।
জোর করে হাসার চেষ্টা করল মুসা। তিন গোয়েন্দার অন্য দুই সদস্য যদি দেখত সে-হাসি, সারা জীবন ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত।
নড়ল না ছেলেটা। কটমট করে তাকিয়ে আছে, পারলে চিবিয়ে খায়। মুখে কোনও কথা নেই। ওর নাকের সামনে মুখ এনে কড়া চোখে চেয়ে আছে।
এক পা পিছাল মুসা। শুকিয়ে ওঠা ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করল। কোনওমতে বলল, ইয়ে, মানে আমি কোন ক্লাসের ছাত্র জানি না। মানে… আমি…আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের ক্লাসরুম কোনটা জানা আছে তোমার?
পরমুহূর্তে বুঝতে পারল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। কারণ এটা কোনও প্রশ্নই হয়নি।
বাঁদর! রাগে ফেটে পড়ল ছেলেটা। বহুত জ্বালাতন করেছ, এবার পেয়েছি! পালাবে কোথায়! চলো আমার সঙ্গে!
কোথায়! বিস্ময়ে দম আটকে এল মুসার। বলে কী গুণ্ডা ছেলেটা?
আমি তোমার কী করলাম! তোমার সঙ্গে যাব কেন? আমি তো তোমাকে চিনিই না!
বিশাল থাবা দিয়ে ওর কাঁধ খাবলে ধরল ছেলেটা। আঁকাতে লাগল।
চেনো না, না? ন্যাকামি হচ্ছে? ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে। চলো বলছি!
উহ! গুঙিয়ে উঠল মুসা। আরে! কী করছো! ব্যথা লাগছে তো! ছটফট করে উঠল মুসা।
ঠিক এমনি সময়ে বই-খাতা হাতে গেট দিয়ে ঢুকলেন টাক-মাথা একজন বয়স্ক টিচার। চেহারা দেখলেই মনে হয় সবসময় ধমকের মুডে আছেন।
আজ ছুটির পর! মুসার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে বলল ধেড়েটা। টেরটি পাবে তুমি, বাছাধন! আমার সঙ্গে চালাকি? বলেই সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। ধীর পায়ে চলে গেল নিজের পথে।
হাঁপ ছেড়ে দ্রুতপায়ে সামনে এগোল মুসা।
সামনে যে-ক্লাস রুম পড়ল, ঢুকে গেল সেটাতেই। একেবারে পিছনের সীটে বসে পড়ল গিয়ে। অচেনা ছেলেটার রক্তচক্ষুর কথা মনে হতে এখনও কেমন যেন লাগছে। কী দোষ করেছে ও?
কয়েক মুহূর্ত পর এক মহিলা টিচার ঢুকলেন ক্লাসে। চুপ হয়ে গেল ক্লাস। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
এসো তা হলে আজকের কাজ শুরু করা যাক, বললেন উনি। তোমাদের বইয়ের সাতান্ন পৃষ্ঠা খোলো দেখি।
এটা কীসের ক্লাস? ভাবল মুসা। পাশের ছেলেটার সামনের খোলা বইটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল।
হায় খোদা! এ যে দেখছি যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়!
এ হতে পারে না।
ওটা অঙ্ক বই!
অঙ্কে সে রীতিমত কাঁচা-ক্লাস এইটের অঙ্কই ঠিকমত মাথায় ঢোকে। কলেজের অঙ্ক করবে কীভাবে?
হঠাৎ খেয়াল করল, টিচার ওরই দিকে চেয়ে আছেন।
মুসা! তোমার কী এখন এই ক্লাসে থাকার কথা?
না! উঠে দাঁড়াল ও। ভুল হয়ে গেছে, ম্যাডাম। যাচ্ছি।
ইচ্ছে করলে থাকতে পারো, অসুবিধে নেই।
না, না, ঠিক আছে! বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল ও।
এখন?
এখন কী করব আমি? ভাবল ও করিডরে দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সময় পার করে দিল।
একসময় ঘণ্টা পড়ল। হলের ও-মাথা থেকে এগিয়ে এলেন একজন টিচার। খাটো, সাদা-কালো একমাথা কোঁকড়া চুল। সামনের ক্লাস রুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মুসাকে দেখে।
আজও তুমি দেরিতে এসেছ? ভ্রূ কুঁচকে বললেন তিনি। এসো এসো, জলদি ঢোকো ক্লাসে।
গোবেচারার মত ক্লাসে ঢুকল ও। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছে, যেন ক্লাসটা কোনওমতে ম্যানেজ করে নিতে পারে।
কিন্তু আসলেই ফাটা কপাল ওর।
এটা ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস।
এখানে পড়ানো হচ্ছে আনা কারেনিনা। একে ওটা বিরাট বই, তারওপর ক্লাসের প্রত্যেককে ওটা থেকে একটু একটু করে পড়তে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, পড়তে পারলেও মুসা আগের কাহিনি জানে না।
তুমি সবার শেষে এসেছ, মুসা, সার বললেন। তাই আজ তোমাকে দিয়েই শুরু করতে চাই। শুরু করো, সাতচল্লিশ পৃষ্ঠা থেকে।
উঠে দাঁড়াল মুসা। উসখুস করতে লাগল। ইয়ে… মানে… সার, আজ আমি ইংরেজি বইটা আনতে ভুলে গিয়েছি।
বেশ করেছ, হাসির ভঙ্গি করলেন উনি। ওর পাশের ছেলেকে বললেন, রয়, তোমার বইটা ওকে একটু ধার দাও দেখি।
রয় মার্টিন এগিয়ে দিল বইটা।
ধন্যবাদ, বিড়বিড় করে বলল মুসা। পা কাঁপছে ঠক্ঠক্ করে। ঘাম ছুটে যাওয়ার অবস্থা।
পৃষ্ঠা সাতচল্লিশ, আবারও বললেন সার।