কিচেনের সামনে এসে আবারও হোঁচট খেল।
মা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা গলা ছেড়ে। বাবা! ভাল করে দেখো তো আমাকে!
তাঁরা দুজন ওর দিকে ঘুরে তাকালেন।
এ কী! এখনও তৈরি হওনি দেখছি, খাওয়া থামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন মা।
কিন্তু মা! মার কথা খেয়াল না করে বলল ও মরিয়া হয়ে। আমি বড় হয়ে গেছি! একরাতের মধ্যে কম সে কম চার-পাঁচ বছর বড় হয়ে গেছি!
তা-ই নাকি! হাসলেন মা। বাবার উপর দিয়ে নজর ঘুরিয়ে এনে ওর উপর স্থির করলেন। আচ্ছা, এখন জলদি খেয়ে নাও, তারপর কলেজের পোশাক পরে এসো। পনেরো মিনিটের মধ্যে বেরোব আমরা।
হ্যাঁ, জলদি যাও, আদেশের সুরে বলল তানজিয়া। তোমার জন্যে আজ আমাদের সবার দেরি হয়ে যাবে।
বাঘের চোখে মামাত বোনের দিকে তাকাল ও। কিছু বলতে গিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলল।
পাশাপাশি বসেছে তানজিয়া ও শাওনি। হাঁ করে দুজনকে পালা করে দেখল মুসা। ওর বয়স যদি আঠারোই হয়, তো তানজিয়া আপুর হবে অন্তত উনিশ। শাওনি মুসার দুই-তিন বছরের বড়। তার মানে এখন শাওনির অন্তত বিশ বছর হওয়ার কথা।
কিন্তু ওদের তা হয়নি।
যেমন ছিল, চোদ্দো আর পনেরো বছর বয়স ওদের। ফারিহাও যেমন ছিল তেমনি আছে!
ওরা সবাই ছোট রয়ে গেছে! অসম্ভব! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এ হতে পারে না, কিছুতেই?
এমন করে হেসে উঠল তানজিয়া, যেন মজা পেয়েছে।
বাবা! মরিয়া কণ্ঠে বলল মুসা। অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটে গেছে। আমার মধ্যে। কাল আমার বয়স ছিল তেরো–আজ আঠারো হয়ে গেছে!
পাগল হয়ে গেল নাকি ও? হেসে উঠল শাওনি। ওর গলা শুনে বিস্মিত হলো মুসা।
মা-বাবা দুজনই তাড়াতাড়ি নাস্তা সারায় ব্যস্ত। ছেলের কথা কানে ঢুকছে না।
কাছে গিয়ে মার হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগল মুসা। মা! তানজিয়া আমার চেয়ে এক বছরের বড়, শাওনি দুই-আড়াই বছরের। ফারিহা আমার তিন-চার বছর ছোট। কিন্তু আজ আমি এত বড় হই কী করে? বাবার দিকে ঘুরে তাকাল। তোমরা আমাকে দেখে কিছু বুঝতে পারছ না? আমি যে বড় হয়ে গেছি বুঝছ না?
কী শুরু করলে তুমি সাত সকালে? একটু বিরক্ত হলেন মা। কী আবোল তাবোল বকছ? তুমি যা ছিলে, তা-ই আছ। জলদি খেয়ে নাও।
খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মা। আজ আমার শপিং করতে হবে। তোমরা তৈরি হয়ে নাও। আমরা যাওয়ার পথে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে যাব।
কিন্তু, মা…
আবার! জলদি টেবিলে বোসো।
কী করার আছে মুসার? বাবা-মা ওর কথায় কান দিচ্ছেন না। তাদের আচরণে মনে হচ্ছে সবকিছু আগের মত স্বাভাবিকই আছে।
অথচ…
নাস্তা নাকে-মুখে গুঁজে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল মুসা। ক্লজিট থেকে স্কুলের পোশাক বের করতে গিয়ে আহাম্মক বনে গেল। ওর আগের ড্রেস সব উধাও হয়ে গেছে। যেসব আছে, আগে কখনও চোখে দেখেনি। সব যেন ওর গায়ের মাপেই তৈরি।
অদ্ভুত কাণ্ড!
এসব তানজিয়া বা শাওনির কোনও ফিচলামি নয়তো? ওর সাথে ইয়ার্কি করছে না তো? ফারিহাটাও ওদের সঙ্গে মিশে…
শুধু ড্রেস নয়, জুতো-স্যাণ্ডেলও ওর বর্তমান সাইজের উপযোগী।
নিশ্চয়ই ওরা আমাকে বোকা বানাতে চাইছে, ভাবল মুসা।
কিন্তু তা-ই বা হয় কী করে? এসব না হয় ওদের কাজ, কিন্তু ওর বড় হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কী? ওদের পক্ষে এমন কাজ কি সম্ভব?
এমনসময় ঘরে ঢুকল পুশি।
ওহ, না! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। যা ভাগ, বেরিয়ে যা বলছি!
তানজিয়ার বেড়ালটা ওর কথা শোনার কোনও গরজ দেখাল না। এগিয়ে এসে মুসার পায়ের কাছে দাঁড়াল। আজ কোনও ত্যাড়ামির লক্ষণ নেই ওটার মধ্যে। কোনও বদ মতলব নেই। যেন দুনিয়াতে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে লেজ দোলানো।
অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে এই বাড়িতে, কাপড় পরার ফাঁকে ভাবল মুসা। ও নিশ্চিত, কোথাও কোনও গড়বড় ঘটে গেছে। বাসার প্রতিটি প্রাণী বদলে গেছে। এমন কী পুশি পর্যন্ত।
কী হলো, মুসা, জলদি এসো! মা তাড়া দিলেন।
বেরিয়ে এল মুসা। বাবা এর মধ্যে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করে তৈরি। অন্যরাও উঠে পড়েছে। মুসাও উঠল।
কিছুক্ষণের মধ্যে মুসার স্কুলের সামনে এসে পৌঁছল গাড়ি। দরজা খুলে নেমে হাঁটা ধরেছিল ও, কিন্তু থামতে বাধ্য হলো।
মুসা! মাথা দোলালেন মা। কোথায় যাচ্ছ তুমি?
কেন, স্কুলে! বিস্মিত হলো ও।
চলি, ফুপু, বলে তানজিয়া নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। শাওনি ও ফারিহাও।
মুসার স্কুলের দিকে এগিয়ে গেল ওরা।
হাঁ করে ওদের দিকে চেয়ে রইল মুসা। বিস্ময়ের যে ধাক্কাটা খেয়েছে, সেটা এত বড় যে সামলে নিতে পারছে না।
দুষ্টুমি রেখে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো, বাবা ঝঝের সঙ্গে বললেন। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ফিরে এসে গাড়িতে উঠল হতভম্ব মুসা। আসল ঘটনা কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে থাকল বাবার দিকে। কখন যে গাড়ি রকি বিচ কলেজের সামনে থেমে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই করেনি।
কী হলো, মার ডাকে সংবিৎ ফিরে পেল ও। কী চিন্তায় পড়লে আবার!
নামছ না কেন? বাবা তাড়া লাগালেন।
ও যখন বুঝল গাড়িটা কোথায় দাঁড়িয়েছে, সশব্দে ঢোক গিলল।
কলেজ! ভয়ে আতা উড়ে গেল ওর। কলেজে গিয়ে আমি কী করব?
মুসা! মা বললেন চরম বিরক্তির সঙ্গে। তোমার কী হয়েছে বলো তো! আজ এমন করছ কেন? জলদি নামো!
রোবটের মত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ও। এ ছাড়া আর কী করার আছে!
যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাবা বললেন। ছেড়ে দিলেন গাড়ি। ওর। চোখের সামনে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে সাঁ করে চলে গেলেন বাবা-মা।