মা, সত্যি! আমার একটা বড় ঘর দরকার। শুধু কী ঘুমাই? ওটায় আমি বাসও করি। অতটুকু ঘরে মানুষ বাস করতে পারে না।
বেশ, ঠিক আছে, বললেন মিসেস রাফাত। আগে ওই ঘরের জিনিসপত্র সরাতে হবে। আগামী শনিবার…
শনিবার? বিষম খেল মুসা। আজই আমি…
বাড়াবাড়ি কোরো না, মুসা, এবার রেগে উঠলেন মা। এখন তোমার ঘরে যাও।
আমার ঘর! এই বাড়িতে আমার কোনও ঘর আছে নাকি? মনে মনে চেঁচিয়ে বলল মুসা। চেহারা থমথম করছে ওর।
এবার যাও, মুসা! বললেন মিস্টার রাফাত।
চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে পড়ল মুসা। রাগে-অপমানে কাঁপতে কাঁপতে ছুটল নিজের ঘরের দিকে।
দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ও। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকল, পড়েই থাকল।
.
কাজটা ঠিক করল না, মা, বিড়বিড় করে নিজেকে শোনাল মুসা। তুমি বলেছ শনিবার দিন, কিন্তু তানজিয়া চোখের ইশারা করেছে, তুমি আমাকে ফাঁকি দিচ্ছ। ফারিহার সব কথা শোনো তোমরা, এমন কী শাওনিরও। যা চায়, তাই দাও ওদেরকে। আর আমাকে… গলা বুজে এল ওর। মন শান্ত। হতে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিল।
গেস্ট রুমটা কেউ ব্যবহার করছে না, ভাবল ও। কাজেই মার কথা শুনব না আমি। আজ থেকে ওই ঘরেই ঘুমাব।
সবাই কখন ঘুমিয়ে পড়বে সে অপেক্ষায় থাকল মুসা। যখন নিশ্চিত হওয়া গেল, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, ধীরে ধীরে উঠে বসল। ঘর থেকে বেরিয়ে বেড়াল-পায়ে এগোল গেস্ট রুমের দিকে।
আজ রাতে ওখানেই ঘুমাবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। দুনিয়ার কোনও শক্তি ওকে বাধা দিতে পারবে না। ২। এ নিয়ে বাসায় হয়তো তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে, ভাবছে মুসা হাঁটতে হাঁটতে। ও অবাধ্য হলে মা ভীষণ রেগে যান, ওকে হয়তো চড় লাগাবেন ধরে। তাতে কী! মুসা মরতে রাজি, তবু আজ থেকে গেস্ট রুমেই ঘুমাবে ও।
সকালে ঘুম ভাঙার পর কী ঘটবে, বুঝতে পারছে না। তবে কপালে যে খারাবি আছে, এটুকু বুঝতে পারছে। হয়তো ওর জীবনটাই বদলে যাবে কাল থেকে।
৩
সকালে ঘুম ভাঙতে মুসার মনে হলো পা দুটো ঠাণ্ডা হয়ে আছে।
কম্বলের তলা দিয়ে বেরিয়ে থাকার কারণে হয়তো, ধারণা করল ও। উঠে বসে কম্বল ঠিক করতে গিয়ে পায়ের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল।
কার পা ও-দুটো? ওর?
তা হলে এত বড় লাগছে কেন? দানবের মত বিশালু না হলেও, যথেষ্ট বড়। গতকাল সাইজ যা ছিল, তার চাইতে অনেক বড়। তার মানে কি সে লম্বা হয়ে গেছে?
এক রাতের মধ্যে?
ছোটরা নির্দিষ্ট একটা বয়স পর্যন্ত বড় হয়, জানে মুসা। তারপর আর দেহ বাড়ে না, বয়স বাড়তে থাকে কেবল। আর সে বেড়ে ওঠার গতি এত ধীর যে চট করে কারও নজরে পড়ে না।
কিন্তু একরাতের মধ্যে ও এত বড় হলে কী করে?
কী ঘটেছে ওর বেলায়?
পা টিপে টিপে গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে এল মুসা। কিচেন থেকে সবার গলা ভেসে আসছে। নাস্তা-পর্ব চলছে।
ভয়-ভয় লেগে উঠল মুসার। আজ খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার ইচ্ছে ছিল, যাতে কেউ টের না পায় ও গেস্ট রুমে রাত কাটিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দেরি হয়ে গেছে। সবাই জেগে গেছে। ব্যাপারটা মা জানতে পারলে কী ঘটবে বুঝতে পারছে না ও। কাল খুব বাহাদুরি ফলিয়ে গেস্ট রুমে ঘুমাতে গেলেও, এখন ভয় করছে। ব্যাপারটা মা জানতে পেরেছেন কি না কে, জানে!
সবার অগোচরে বাথরুমের সামনে এসে দাঁড়াল ও। সবকিছু কেমন যেন ছোট ছোট লাগছে।
বাথরুমের দরজার হাতলটা যখন ধরল, কেন যেন মনে হলো ওটা জায়গা বদল করেছে। রাতে কেউ এসে ওটাকে নীচে লাগিয়ে দিয়েছে।
ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল মুসা। মনে হলো, সিলিঙ অনেক নীচে নেমে এসেছে। লাইট জ্বেলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল।
কে ওটা! ও?!! নাকি আর কেউ!!!
নিজের প্রতিবিম্বের উপর থেকে চোখ সরাতে পারল না। চেহারাটা ওরই, কিন্তু তারপরও কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। গালদুটো একটু ফোলা
ফোলা লাগছে। কালও নাকের নীচের গোঁফের রেখাটা এত স্পষ্ট ছিল না। ঠোঁট দুটোও এক রাতের মধ্যে পুরু হয়ে উঠেছে। এবং কালকের চেয়ে কম করে হলেও ছয় ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে ও।
আমি… আমি বড় হয়ে গেছি? ভাবল ও কাঁপতে কাঁপতে। একরাতের মধ্যে কম করে হলেও কয়েক বছর বয়স বেড়ে গেছে আমার! তার মানে… কাল ওর বয়স ছিল তেরো, আজ হয়েছে সতেরো-আঠারো! এ কী আজব কাণ্ড!
না, না… একশো মাইল বেগে চিন্তার ঝড় বইছে ওর মাথায়। এ হতে পারে না। নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি আমি। বাস্তবে এসব ঘটতে পারে না।
একমিনিট চোখ বুজে থাকব আমি, ভাবল ও। যখন খুলব, নিশ্চয়ই আবার আগের মুসা হয়ে যাব।
চোখ বুজল মুসা। এক হাজার এক, এক হাজার দুই করে ষাট পর্যন্ত গুনল।
তারপর ধীরে ধীরে তাকাল।
নাহ, কিছুই তো স্বাভাবিক হয়নি। সব আগের মতই আছে।
ও আসলেই এখন সতেরো-আঠারো বছরের তরুণ!
বুকের মধ্যে হৃত্যন্ত্রের লাফালাফি চলছে। রিপ ভ্যান উইঙ্কলের গল্প জানা আছে ওর। একশো বছর ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল সে। ঘুম ভাঙার পর দেখল সব বদলে গেছে।
ওর বেলায়ও তা-ই ঘটেছে নাকি? ভাবল মুসা। টানা কয়েক বছর ঘুমিয়ে কাটিয়েছে ও?
হাত-মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে ছুটল মুসা। অস্বাভাবিক কিছু ঘটে থাকলে মা-বাবা, ফারিহা-শাওনি-তানজিয়া নিশ্চয়ই দেখতে পাবে।
কয়েক পা এগিয়েছে, এমনসময় হোঁচট খেল মুসা। পা দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হলো, মস্তিষ্কের নির্দেশ মানছে না ওরা।