চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল মুসার। পাশের বাড়ি ঘুরে ছুটে চলে এল ওদের বাড়ির পিছন দিকে। এদিকটা ঝোপ জঙ্গলে ভর্তি। ছোট একটা ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে পড়ল।
কয়েক মিনিট পর পায়ের শব্দ উঠল। হাঁপাচ্ছে ওরা তিনজনই।
কোথায় গেল? সানজানার গলা শোনা গেল।
ওদিকে গেছে মনে হয়, সামনে আঙুল তুলে দেখাল ব্যাবলা। জলদি চলো।
চলে গেল ওরা।
এতক্ষণ দম নেয়ার কথা মনে ছিল না মুসার, নড়াচড়া দূরে থাক্। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা দম ছাড়ল এবার আস্তে আস্তে।
এ যাত্রা বাঁচা গেছে। কিন্তু জানা আছে ওদের হাতে ধরা পড়তেই হবে। ওকে।
যে কাজ করলে এদের হাত থেকে বাঁচা যায়, তা কীভাবে করা সম্ভব ভেবে অস্থির হয়ে উঠল মুসা। মা পর্যন্ত ওকে চিনতে পারলেন না। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে? কিছুতেই ওকে বাসায় ঢুকতে দেবেন না মা। এবং ভিতরে যেতে না পারা পর্যন্ত ওর কোনও আশাও নেই।
এখন একটাই পথ খোলা আছে ওর সামনে, চুপি চুপি ঢোকা। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ওকে। সবার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে। তারপর চোরের মত…
অপেক্ষার পালা শুরু হলো। ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকল ও। বসে থাকতে থাকতে ব্যথা হয়ে গেল হাত-পা। বাধ্য হয়ে ওখানেই ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। রিয়্যালিটি পুলিশের ভয়ে ঝোপের আড়াল থেকে বেরোতে পারছে না। ওদের চোখে পড়া চলবে না।
ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। জেগে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু ঘুমানো চলবে না। নতুন আর কোনও সমস্যায় পড়তে রাজি নয় মুসা।
ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলেছে সময়। অবশেষে এক যুগ পর রাত নামল। একটু একটু করে গম্ভীর হলো, নীরব হয়ে এল চারদিক।
সময় হয়েছে মনে হতে উঠে দাঁড়াল মুসা। আড়মোড়া ভেঙে জড়তা কাটাল।
বাসার দিকে তাকাল। মা-বাবা জেগে আছেন এখনও। বাতি জ্বলছে। ফারিহা, তানজিয়া আর শাওনি ভাই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ঘরে বাতি নেভানো।
মা-বাবার ঘরের বাতিও নিভে গেল একসময়। আঁধার হয়ে গেল পুরো বাড়ি। তবু আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল মুসা। সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ধীর পায়ে বাসার সামনের দিকে চলে এল। ওদের ড্রইং রুমের একটা জানালায় গরাদ নেই। ওটার সামনে এসে দাঁড়াল।
যা ভেবেছিল তা-ই।
বন্ধ।
আবার চলে এল পিছন দিকে। কিচেনের দরজা খুলে ফেলল কায়দা। করে, নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল।
যাক্, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। সবুরে মেওয়া ফলেছে তা হলে। অবশেষে বাঁচার উপায় জুটল।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সমস্ত দরজা-জানালা ঠিকমত লাগানো। আছে কি না পরখ করে দেখেন বাবা। আজও নিশ্চয়ই করেছেন। কিন্তু তাতে কী? এই দরজাটা যে বিশেষ কায়দায় খোলা যায়, তা তো উনি জানেন না।
একটু একটু করে মুসার নিভু নিভু আশার আলোটা উজ্জ্বল হচ্ছে আবার। এখন সামনে আর একটাই বাধা ওর ঘরের দরজা। ওটা খোলা থাকলে হয়।
বেড়াল-পায়ে এগোল ও করিডর ধরে। নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, খোলা! জীবনে কখনও এত খুশি হয়েছে কি না মনে করতে পারল না মুসা। এবার ভিতরে ঢুকে একটা ঘুম দেবে ও, ব্যস, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার আগের মুসা হয়ে যাবে ও।
খুশিতে ধেই-ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে। চেঁচিয়ে ঘুমিয়ে পড়া শহরকে জাগাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেসব কিছুই করল না ও। টুক করে ঢুকে পড়ল ঘরে। ওই তো ওর বিছানা। শূন্য! শুয়ে পড়লেই হলো।
এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে বিছানা ঝাড়ল ও। তারপর জুতো খুলে উঠে। পড়ল। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
আবার নিজের বিছানায় ঘুমাতে যাচ্ছে মুসা, সেই আনন্দে দিশেহারা। গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে।
এখন যদি কেউ দেখে ফেলে ওকে, কী ভাববে? চোর? নিশ্চয়ই তা-ই। মা-ই যখন চিনতে পারলেন না…
সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে দূর করে সকালের কথা ভাবল মুসা। কী ঘটবে কাল? নিজেকে সত্যি কি ফিরে পাবে ও? সানজানার কথা সত্যি হলে তা-ই তো হওয়া উচিত।
ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এল মুসার। ভারী হয়ে উঠল শ্বাস-প্রশ্বাস।
মেয়েটা সত্যি বলেছে কি না আর কয়েক ঘণ্টা পরই প্রমাণ হয়ে যাবে।
একসময় ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল মুসা।
২৮
নাকেমুখে গরম লেগে উঠতে ঘুম ভাঙল মুসার। সূর্যের আলো।
চোখ মেলে তাকাল। কোথায় আছে ও এখন? দ্রুত চারদিকে নজর বোলাল। ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে আছে ও। এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘর। ওরই ঘর!
হার্টবিট বেড়ে গেল মুসার। সানজানা কি সত্যি বলেছিল? স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে ও?
দেরি সহ্য হলো না। তড়াক করে উঠে পড়ল মুসা। দরজার সাথে লাগানো ছোট্ট আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল।
হ্যা!!!
ও আবারও মূসা হয়ে গেছে। নিজেকে ফিরে পেয়েছে ও!
ইয়াহ্হু! আনন্দে অস্থির হয়ে দুহাত শূন্যে ছুঁড়ল মুসা। এমন সময় দরজাটা একটু ফাঁক হলো। নাক ঢুকিয়ে দিল পুশি। ভিতরে ঢুকে ডাক ছাড়তে শুরু করল। অন্য সময় হলে বিরক্ত হতো মুসা, কিন্তু আজ হলো না।
বরং ওটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। ছাড়া পাওয়ার জন্যে উল্টে পুশিই মরিয়া হয়ে লাফালাফি শুরু করে দিল। মুসাকে একদম পছন্দ করে না ওটা।
মুসা! কিচেন থেকে মা ডেকে উঠলেন।
ওর আসল মা!
মুসা! পুশিকে ব্যথা দিচ্ছ কেন? ছেড়ে দাও।