ছোট একটা বাটিতে করে কিছু ছোলা নিয়ে এসেছে ওরা। দরজা খুলে। বাটিটা ভিতরে ঠেলে দিল।
ছোলা মোটেই পছন্দ নয় মুসার। কিন্তু খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। তা-ই বাধ্য হয়ে খেতে হলো।
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। এক মুহূর্ত পর শাওনি ভাইয়ের গলা শোনা গেল, তানজিয়া, তোমার টেলিফোন।
ফারিহা, এসো তো একটু, ডাক দিলেন মা।
আসছি, উঠে দাঁড়াল তানজিয়া ও ফারিহা। দৌড়ে বেরিয়ে গেল ওরা।
হতাশ ভঙ্গিতে বসে কুটকুট করে ছোলা খাচ্ছিল মুসা। তানজিয়া যে খাঁচার দরজা বন্ধ না করেই চলে গেছে, বুঝতে বেশ সময় লাগল।
ইয়াহ্ হু! ব্যাপারটা চোখে পড়া মাত্র কাঠবিড়ালীর ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বোনের বোকামির প্রমাণ পেয়ে আনন্দ আর ধরে না।
সামনের থাবা দিয়ে ধাক্কা মেরে দরজা খুলে ফেলল ও। খাঁচা থেকে বেরিয়ে সতর্ক পায়ে দরজার দিকে এগোল। কান খাড়া।
উঁকি দিয়ে দেখল করিডর খালি। কারও পায়ের শব্দ পাওয়া গেল না। এই তো সুযোগ!
দ্রুত ওর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
দরজা বন্ধ। কাঠবিড়ালীর ছোট্ট থাবা দিয়ে মরিয়া হয়ে ওটা ঠেলল কিছুক্ষণ, লাভ হলো না। খুলল না দরজা।
আর কী করার আছে ওর?
কপাল খারাপ।
পায়ের শব্দ কানে আসতে সচকিত হলো মুসা। তানজিয়া ফিরে আসছে।
মুসা জানে তানজিয়া ওকে দেখে ফেলার আগেই পালাতে হবে এখান থেকে। নইলে আবার খাঁচায় বন্দি হতে হবে।
এক ছুটে ড্রইং রুমে চলে এল ও। জানালা, কি খোলা? হ্যাঁ, ভোলাই
দৌড়ে সোফার পিছনে, চেয়ারের তলায় চলে এল মুসা। দেয়াল বেয়ে উঠে জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল সুড়ৎ করে। লাফিয়ে পড়ল উঠনে। পরক্ষণে পাশের একটা গাছে উঠে পড়ল দ্রুত। একটা ডালে বসে নিজেকে সুস্থির। হওয়ার সময় দিল।
নিজের ঘরে ঢুকতে পারেনি মুসা। ব্যর্থ হয়েছে। এখন ওর একটা কাজই কেবল করার আছে।
ঘুমাতে হবে। বলা যায় না, হয়তো আবার মানুষ হয়ে জেগে উঠতে পারে। সেটাই একমাত্র ওর ভরসা। সে ক্ষেত্রে বাঁচার একটা উপায় হবে হয়তো। নইলে….
যে করে হোক ওর ঘরে ঢুকতেই হবে। ঘুমাতে হবে। নইলে…
আর ভাবতে পারছে না।
রিয়্যালিটি পুলিশ ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এবং ওরা যে মুসাকে খুঁজে বের। করবেই, তাতে কোনও ভুল নেই। ওদের চোখ ফাঁকি দেয়া যায় না।
আর একবার ধরা পড়লে ওকে বাঁচাতে পারবে না কেউ।
২৬
পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে জেগে উঠল মুসা। দেখল গাছের নীচে চিত হয়ে পড়ে আছে। ব্যাপার বুঝতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল। চিন্তা করতে করতে গাছের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভাগ্যিস নিচু ডালে বসেছিল। নইলে হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকত না। পাউডার হয়ে যেত।
ঘুম তো ভাঙল, কিন্তু এখন ও কে? কী?
পরমুহূর্তে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। আবার তেরো বছরের কিশোরে পরিণত হয়েছে ও। তবে নিজেকে ফিরে পায়নি, অর্থাৎ তেরো বছরের এক কিশোর ও হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মুসা হতে পারেনি।
নিজেকে দেখে হাসি পেল মুসার। কুমড়োপটাশ মার্কা স্থূল দেহ। এই জন্যই গাছের ডাল ওর ভার সইতে পারেনি। দেহের এখানে সেখানে চর্বি থলথল করছে।
কিন্তু এটা কোনও সমস্যা নয়। আবার ও মানুষ হতে পেরেছে, সেটাই। বড়। এখন ও কথা অন্তত বলতে পারবে।
এবং এখন নিজের ঘরে ঢোকার একটা সুযোগ পেয়েও যেতে পারে ও।
বুক চিতিয়ে সামনের দরজার দিকে এগোল মুসা। দরজা বন্ধ। কলিং বেলে চাপ দিল। একটু একটু করে উত্তেজিত হয়ে উঠছে।
কে দরজা খুলবে বুঝতে পারছে না মুসা। মনে মনে আশা করছে সেই মানুষটি ওর পরিবারের কেউ যেন হয়।
খুলে গেল দরজা।
মা! খুশিতে আত্মহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। মা! আমি ফিরে এসেছি! আমি মুসা!
চোখ কুঁচকে উঠল মার।
কে? কণ্ঠে সন্দেহ ফুটল। মুসা! মুসা কে? এই নামের কাউকে চিনি বলে তো মনে পড়ছে না।
সে কী, মা! আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল ও। অবশ্যই চেনো! আমি তোমার ছেলে, মুসা!
অনিশ্চিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
ফারিহা, তানজিয়া ও শাওনি এসে দাঁড়াল মার পিছনে। ছেলেটা কে, ফুপু? জিজ্ঞেস করল তানজিয়া।
ফারিহা! চেঁচিয়ে উঠল ও। শাওনি ভাই! আমি মুসা, আমি ফিরে এসেছি!
এ কে, শাওনি? জানতে চাইল তানজিয়া।
চিনি না তো! কপাল কুঁচকে দেখছে ওকে শাওনি।
হায় খোদা! ভাবল মুসা। এসব কী হচ্ছে! মুখ ঘুরিয়ে আর বসে থেকো না তুমি। আমার দিকে তাকাও। বিপদ থেকে উদ্ধারের এত কাছাকাছি এসেও কী…
আবেদন ফুটল ওর কণ্ঠে। প্লিজ, মা। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও, আমাকে ঘুমাতে হবে। আমার ঘরে ঘুমাতে দাও। এ আমার জীবন-মরণ সমস্যা।
কিন্তু আমরা তো চিনতে পারছি না, তোমাকে, বললেন মা। মুসা নামের কাউকে চিনি না আমরা। মনে হয় ভুল বাসায় এসে পড়েছ তুমি।
পাগল না তো? শাওনি বলে উঠল।
অথবা ধান্দাবাজ, বলল তানজিয়া।
না, আমি ওসব কিছু নই,ব্যস্ত হয়ে বলতে চাইল ও। মা…
মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন মা।
হতাশায় অন্তর ছেয়ে গেল মুসার। ঘুরে রাস্তার দিকে তাকাল।
এখন? কী করবে ও?
সামনের দৃশ্য দেখে আত্মা উড়ে গেল মুসার।
তীর বেগে ওর দিকে ছুটে আসছে সেই তিনজন।
সানজানা, মিজু আর ব্যাবলা।
রিয়্যালিটি পুলিশ!
আবার ধরা পড়ে গেছে মুসা!
২৭
ওই তো! আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলল সানজানা। ওই তো! জলদি চলো! তিনজন সোজা দৌড়ে এল ওর দিকে।
ধরো, ধরো!
ঘুরেই দৌড় দিল মুসা। কিন্তু কাজটা যে এ মুহূর্তে ওর জন্য কত কঠিন, টের পেতে দেরি হলো না। মোটাদের জন্য দৌড়ানো সত্যিই কঠিন।