মুক্তির আনন্দে ধেই-ধেই করে খানিক নেচে নিল।
ইয়াহহু!
তারপর যত দ্রুত সম্ভব বন-বাদাড় ভেঙে বাড়ির খোঁজে ছুটল। কিছুক্ষণ পর শহরে ফেরার রাস্তা পেয়ে গেল ও, ওটা ধরে ছুটতে শুরু করল তুফান বেগে।
শহরে পৌঁছে দেখা গেল সব আগের মতই স্বাভাবিক। দানবকে নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল, তার চিহ্নই নেই।
আসলে আগের রিয়্যালিটিতে নেই ও, বুঝতে পারল মুসা। আরেক বাস্তবে আছে এখন। ও এখন কাঠবিড়ালী।
বাতাসে নাক টানল মুসা। নানান রকমের সুগন্ধে ম ম করছে চারপাশ। নিজের ঘ্রাণশক্তির প্রশংসা না করে পারল না। এখন গন্ধ শুঁকে শুঁকে সহজেই নিজের বাসা খুঁজে বের করতে পারবে।
লাফাতে লাফাতে ছুটল মুসা। কিন্তু রাস্তা পেরোতে গিয়ে ঝামেলা ঘটিয়ে বসল। উত্তেজনার চোটে মার সতর্কবাণীর কথা ভুলেই বসেছিল।
উনি সবসময় বলতেন দুদিকে ভাল করে দেখে নিয়ে তবে রাস্তা পার হবে।
ওর অসতর্কতার সুযোগে বাঁ দিক থেকে ছুটে এল যন্ত্র-দানব একটা ট্রাক ড্রাইভার ওকে দেখতেই পায়নি। মানুষই চোখে পড়ে না ওদের, ও তো ছোট্ট একটা কাঠবিড়ালী!
ভাবার সময় পেল না মুসা। আচমকা চোখের সামনে পাহাড় সমান উঁচু চাকা দেখে আঁতকে ওঠারও সময় পেল না। কেবল প্রাণের সহজাত তাগিদে সরে যাওয়ার দুর্বল চেষ্টা করল একবার।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।
সভয়ে চোখ বুজল মুসা।
ভাবল, এভাবেই মরণ লেখা ছিল কপালে?
গাড়ির চাকার নীচে ভর্তা হয়ে মরব?
২৪
রাস্তার সঙ্গে চাকার তীব্র ঘর্ষণের আওয়াজ উঠল।
দাতমুখ খিঁচিয়ে কড়া ব্রেক কষেছে ড্রাইভার। প্রায় জায়গায় দাঁড় করিয়েছে গাড়ি। তারপর আচমকা নীরব হয়ে গেল চারদিক।
ধীরে ধীরে, ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল মুসা। একটা চাকা ওর ছোট্ট মাথাটার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে থেমেছে। খুব সামান্যর জন্য এ যাত্রা প্রাণটা রক্ষা পেয়েছে ওর।
গাড়িটার নীচ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল মুসা, রাস্তা পেরোল। আবার চলতে শুরু করল ট্রাক।
রাস্তার কিনারা দিয়ে বাড়ির পথ ধরল মুসা। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে তেড়ে এল ওর দিকে। উপায় নেই দেখে চট করে পাশের একটা গাছে উঠে পড়ল ও। নইলে বাঁচতে পারত না ওটার হাত থেকে
গাছটার নীচে সামনের দুপা তুলে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দাঁত খিঁচাল কুকুরটা। গাছের গা আঁচড়াল তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে। ভয় দেখাল মুসাকে।
কিন্তু ওর তরফ থেকে কোনওরকম উৎসাহ না পেয়ে এক সময় আগ্রহে ভাটা পড়ল ওটার। চলে গেল।
গাছ থেকে নেমে আবার চলতে শুরু করল মুসা।
গাড়ি, মোটরসাইকেল, সাইকেল, মানুষ, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদির বাধা পেরিয়ে অবশেষে ওদের বাসার সামনে এসে দাঁড়াল।
চিরচেনা বাসা চোখে পড়তে মন আনন্দে নেচে উঠল। ওটা দেখে জীবনে কখনও এত খুশি হয়নি ও।
সানজানা বলেছে, ওর ছোট্ট ঘরে যেখানে ঘুমাত, সেখানে একবার ঘুমাতে পারলেই আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে ও। রিয়্যালিটির গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
কীভাবে কাজটা সম্ভব, সেই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওর। একটা কাঠবিড়ালীর পক্ষে কাজটা যে কঠিন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সমস্যা আরও আছে।
বাসায় এখন ওর আসল বাবা-মা থাকেন কি না জানা নেই। ও এখন যে বাস্তবে আছে, সেখানে এই বাসার অধিবাসী কারা কে জানে!
মুসা মনেপ্রাণে আশা করছে ওর পরিবারকেই যেন পাওয়া যায় বাসায়। তা হলে কাজটা ওর জন্য হয়তো সহজ হবে কিছুটা।
নইলে…
ওর ঘরের জানালার গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা মস্ত ওক গাছটায় উঠে পড়ল মুসা। যে-ডালটা একেবারে জানালার কাছ দিয়ে গেছে, সাবধানে ওটার মাথায় চলে এল।
জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে নিজের ঘরে উঁকি দিল।
নিজের সেই অপছন্দের ঘরটাকে আজ এত ভাল লাগল, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয় ওর।
ওই তো ওর বিছানা!
সেই চেয়ার!
সেই টেবিল!
সেই বইপত্র!
সব জায়গামতই আছে।
কিন্তু ভিতরে ঢোকার উপায় নেই। জানালা বন্ধ। ছোট্ট থাবা দিয়ে কাঁচের পাল্লা খোলার চেষ্টা করল মুসা। কাজ হলো না। খুলল না পাল্লা।
গাছের এ-ডাল ও-ডাল করে অন্য জানালাগুলোও পরখ করে দেখল মুসা। সবগুলো বন্ধ।
নাহ, জানালা দিয়ে ঢোকা সম্ভব নয়। দরজা দিয়ে ঢোকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কাজটায় ঝুঁকি আছে। কেউ দেখে ফেললে নিশ্চয়ই দূর! দূর! করে তাড়িয়ে দেবে ওকে। তবু চেষ্টা করতে হবে। তীরে এসে তরী ডুবলে আফসোসের সীমা থাকবে না।
বাসায় কেউ আছে? সামনের জানালার ওপাশে ড্রইং রুম। ভিতরটা ভাল করে দেখার চেষ্টা করল মুসা। পরক্ষণে আনন্দে মন নেচে উঠল।
ওই তো মা! ওর আসল মা! ফারিহা, তানজিয়া আপু, শাওনি ভাই!
সবাই আছে দেখছি! ফিরে এসেছে! আপনজনদের পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল মুসা। উত্তেজিত হয়ে উঠল। এ ডাল থেকে ও ডাল করল কিছুক্ষণ।
এমন সময় হঠাৎ পুশির মিয়াও ডাক কানে আসতে জমে গেল।
ওহ, হ্যাঁ। ওই ব্যাটার কথা দিব্যি ভুলে বসেছিল মুসা। ওটাকে দেখে মনের খুশি খুশি ভাবটা মারাত্মক এক হোঁচট খেল।
ইঁদুর জাতীয় যে-কোনও প্রাণীকে তাড়া করা বেড়ালদের প্রিয় খেলা
জানা আছে মুসার। এরইমধ্যে জানালা দিয়ে ওকে দেখতে পেয়ে খেপে উঠেছে বাঘের মাসি। কী যন্ত্রণা!
ফারিহা হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। মুসার দিকে আঙুল তুলে কী যেন বলল মাকে।
হা! ভাবল মুসা। ফারিহা, এসো। এসে আমাকে নিয়ে যাও। জানালা খোলো, প্লিজ! আমাকে ভেতরে নিয়ে যাও। আমি কাঠবিড়ালী নই, তোমার ভাই, মুসা।