কালঘুম!
রিয়্যালিটির গর্তে পড়ার পর থেকে একের পর এক বিপদে পড়েই চলেছে ও। কিন্তু এই বিপদের কোনও তুলনা হয় না। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদ আর কী হতে পারে?
মৃত্যুর ঘণ্টা বাজছে ওর!
অসহায়ভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ছাড়া আর কিছু করার নেই!
কিন্তু তারপরও মনের কোণে এক চিলতে আশার আলো দেখতে পেল ও। কেন, কীসের আলো, তা নিজেও জানে না।
ওর অবচেতন মন বলছে, এ যাত্রা তুমি বেঁচে যেতেও পারো, মুসা!
আচমকা একটা ব্যাপার মনে পড়ল। এর আগের একেক বিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার পেয়েছে ও?
মুসা ঘুমিয়েছে, ঘুম থেকে ওঠার পর আরও কঠিন বিপদে পড়েছে ঠিক, তবে আগেরটা কেটে গেছে।
ঘুম ভাঙার পর মহাবিপদে পড়েছে সত্যি, কিন্তু এখনকারটার চেয়ে বড় বিপদ আর কী হতে পারে?
ভাবতে গিয়ে ওর মনের আশার আলোটা একটু উজ্জ্বল হলো।
এখন যদি ও আবার ঘুমিয়ে পড়ে, তা হলে নতুন আরেক রিয়্যালিটিতে জেগে উঠবে। এবং বদলে যাবে। দানব যখন হয়েছে, তখন পাখি হওয়াও অসম্ভব নয়, কিংবা বেড়াল।
তার মানে…তার মানে… এই বন্দিদশা থেকে…
কিন্তু সমস্যা হলো এই মুহূর্তে কীভাবে ঘুমানো সম্ভব? মাথা চরকির মত চক্কর খাচ্ছে। একশো মাইল বেগে দুইশো রকমের চিন্তার টর্নেডো বয়ে চলেছে।
কিন্তু তবু চেষ্টা করতে হবে, ভাবল ও। চট করে শক্ত মেঝেতে শুয়ে পড়ল। হাতে সময় খুব কম। ওরা ফিরে আসার আগেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
বিছানা নেই।
বালিশ নেই।
কম্বল নেই।
দিনের আবছা আলো আসছে জানালা দিয়ে।
তা ছাড়া মাথার উপরে মৃত্যু ঝুলছে জেনে ঘুম দেয়া বড় কঠিন কাজ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
তবু তোমাকে পারতেই হবে, মুসা, নিজেকে মনে মনে শোনল ও। তোমার খালাতো-মামাতো ভাই-বোনরা তোমাকে সবসময় বলত, তুমি ঘুমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, টর্নেডোর মধ্যে খোলা মাঠে ঘুমাতেও অসুবিধে হবে না। তোমার। কাজেই তোমার পারা উচিত, মুসা, তোমাকে পারতেই হবে।
মা-বাবার কথা মনে পড়ল। মনে হলো দীর্ঘ কয়েক যুগ ওঁদের দেখে না ও। ফারিহা, তানজিয়া আপু, শাওনি ভাই
ওদেরকেও দেখে না কত যুগ।
আবার ওদের সবাইকে ফিরে পেতে চায় মুসা। ফিরে পেতে চায় প্রিয়। বন্ধু কিশোর-রবিন-রেমন-জিনা-শ্যারনকে।
ভাবতে ভাবতে চোখ বুজল মুসা। ছোট বেলায় মা সুর করে ছড়া কেটে ঘুম পাড়াতেন। তার একটা ছিল:
ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি
মোদের বাড়ি এসো,
খাট নেই পালঙ্ক নেই
খোকার চোখে বোসা…
ছড়াটা মনে করার চেষ্টা করল মুসা। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নিজেই নিজেকে সেটা সুর করে শোনাতে লাগল ও।
তারপর… তারপর একসময় তলিয়ে গেল ঘুমের অতলে।
২৩
চোখ মেলে তাকাল মুসা। চোখ ডলল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? নিজেকে প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, তা-ই তো!
এখন কোথায় ও?
উপরে তাকাল, সিলিঙ চোখে পড়ল।
চারদিকে তাকাল। দেয়াল।
একটা দরজা।
অনেক উপরে একটা জানালা-জেলখানার মত। লোহার গরাদ রয়েছে। ওটায়।
না! ফিসফিস করে বলল ও। আমি এখনও সেই বাড়িতেই?
হ্যাঁ, তা-ই। এখনও বনের মধ্যে সেই বাড়িতে বন্দি ও।
বন্দি।
ভেস্তে গেছে ওর পরিকল্পনা।
এখন কী করবে?
নাআআআআ!
রাগে, হতাশায়, মত্যভয়ে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো মুসার। কাজ হয়নি ওর পরিকল্পনায়। আর কোনও বুদ্ধি মাথায় আসছে না। মাথার মধ্যে মগজ বিস্ফোরিত হতে পারে যে-কোন মুহূর্তে। এখন কী করবে ও? জানে না। কিছু খেলছে না মাথায়। উদ্ধার পাওয়ার যে ক্ষীণ আশার আলো দেখা দিয়েছিল, তা বিলীন হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে। বাঁচার আর কোনও উপায় নেই!
পাশের ঘর থেকে ওদের গলা ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই ওকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর প্রস্তুতি চলছে। নাকি প্রস্তুতি শেষ? এখনই আসবে ওরা?
একটু পরেই ওকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে? বাবা-মা-ভাই বোনের সঙ্গে, বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে না!
রিয়্যালিটি পুলিশ এত নির্দয় কেন? কেন এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওরা? কাজটা কি ঠিক হলো?
কোনও অন্যায় তো করিনি আমি, ভারত মুসা। অন্তত নিজের ইচ্ছেয় নয়। যা করেছে, না জেনে, ভুলে করে বসেছে। ওরা কি এটাকে ক্ষমা করে দিতে পারত না?
যত ভাবছে, তত রাগ বাড়ছে ওর। সহ্য করতে না পেরে আবার চেঁচিয়ে উঠল, নাআআআআআ!
কিন্তু, এবার কণ্ঠস্বর কেমন যেন অন্যরকম শোনাল।
নাআআ!
না বলছে মুসা। কিন্তু শুনতে পেয়েছে অন্যকিছু।
নিশ্চিত হতে আবারও বলল, না!
আওয়াজ হলো, ইইই!
গলাটা ওরই। কিন্তু আওয়াজটা মানুষের গলার মত শোনাল না।
শোনাল অন্য কিছুর মত।
সে আবার কী! তাজ্জব হয়ে ভাবল মুসা।
মুখ নিচু করে নিজের দিকে নজর দিল মুসা।
এতক্ষণ মনে ছিল না। উত্তেজনায় এতই বেহাল দশা, ঘুম থেকে জাগার পর ওর যে বদলে যাবার কথা, তা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল।
হ্যাঁ, বদলে গেছে মুসা।
ইয়াল্লা! একী!
এতটুকুন হয়ে গেছে ও। এখন খুব বেশি হলে আট ইঞ্চি হবে ও লম্বায়।
ছোট, সরু দুই থাবায় পরিণত হয়েছে হাতদুটো। গায়ে ধূসর পশম। পিছনে লম্বা, মোটা লেজও আছে।
কাঠবিড়ালী! আঁতকে উঠল মুসা।
ও এখন একটা কাঠবিড়ালী!
চট করে জানালাটার দিকে নজর গেল ওর। এখন গরাদের সরু ফাঁক দিয়ে ওর পক্ষে বের হওয়া কোনও সমস্যাই নয়। একেবারে জলবৎ তরলং।
আর একমূহুর্ত সময়ও নষ্ট করল না মুসা। চোখের পলকে দেয়াল বেয়ে অনায়াসে উঠে পড়ল। বেরিয়ে এল ফাঁক গলে।