কেন! কেন তোমরা আমাকে ধরেছ?
আমাদের চোখের সামনে বারবার তুমি আইন ভাঙবে, হাত মুঠো করে ঘুসি দেখাল মিজু। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব, কীভাবে ভাবতে পারলে তুমি?
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল মুসা। তর্জনীর ডগা কপালে ঠুকল। কিন্তু আমাদের গেস্ট রুমে রিয়্যালিটির গর্ত এল কোত্থেকে?
প্রাকৃতিক নিয়মে, জবাব দিল সানজানা। আরও কিছুদিন হয়তো থাকবে ওটা। তারপর আবার প্রাকৃতিক নিয়মে সরে যাবে। ওই ঘরে সেই রাতে কারও থাকার কথা ছিল না। তুমি বেয়াড়া ছেলে, কারও কথা না মেনে ওই ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছ!
আচ্ছা, তা হলে ওই গেস্ট রুমই সব অনর্থের মূল, তা-ই না? ওই অপয়া ঘরে ঘুমিয়েছিলাম বলেই তোমাদের, আমার সবার এত দুর্ভোগ পোহাতে হলো?
হ্যাঁ।
আর কখনও ওই রুমে আমি ঘুমাব না! শপথ করার ভঙ্গিতে বলল মুসা। এখন যেমন আছি, তেমন বেঁচে থাকতে আমার কোন আপত্তি নেই। আগের জীবনে ফিরে না-ই বা গেলাম।
মাথা দোলাল সানজানা। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, মুসা। তুমি গর্তের এত গভীরে চলে গেছ যে সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এখন তুমি যেখানেই ঘুমাও, বদলে যাবে, রিয়্যালিটি আইন বারবার লঙ্ঘিত হবে।
তার মানে… তার মানে আমাকে তা হলে তোমরা আর কখনও ঘুমাতে দেবে না?
আসলে ঠিক তা নয়, বলে দুই সঙ্গীকে পালা করে দেখল সানজানা। তারপর গভীর চোখ মেলে তাকাল ওর দিকে।
আমি দুঃখিত, মুসা। সত্যি সত্যি খুব দুঃখিত। ছেলে হিসেবে তুমি চমৎকার। তোমাকে ভীষণ ভাল লেগেছিল আমার। কিন্তু এখন করার কিছু নেই। আইনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না আমি।
মা-মানে… কী-কী বলতে চাও তুমি! সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে হয়ে উঠল মুসার চেহারা।
মুসার একটা হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল সানজানা। সত্যি আমরা নিরুপায়। তোমাকে আমরা ঘুম পাড়িয়ে দেব। চিরতরে।
২২
ঝাঁকির উপর ঝাঁকি খেল মুসা। এত মানসিক চাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ল।
সা-সানজানা, এ-এ কী বলছ তুমি? তোতলাতে লাগল।
ও ঠিকই বলেছে, জোর দিয়ে বলল ব্যাবলা।
এ হতে পারে না! ফিসফিস করে বলল মুসা। পড়িমরি করে দরজার দিকে ছুটতে চাইল। কিন্তু মিজু আর ব্যাবলা তৈরি হয়েই ছিল। দুদিক থেকে ওর দুবাহু জাপটে ধরল ওরা।
পালাতে পারবে না, হাসল মিজু। শুধু শুধু চেষ্টা কোরো না।
ছেড়ে দাও আমাকে! চোখের কোণে পানি চিকচিক করে উঠল মুসার। মেরে ফেলো না, প্লিজ!
ওদের শক্ত থাবা থেকে ছোটার প্রাণপণ চেষ্টা করল ও। কিন্তু লাভ হলো না। জন্মের মত শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে মুঠো। ছুটছে না। বলিষ্ঠ দুই যুবকের সঙ্গে ওর পেরে ওঠার কথা নয়। ভয়, উত্তেজনা আর ঘটনার আকস্মিকতায় মুসা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে শক্তিতে এখন সানজানার সঙ্গেও পারবে বলে ভরসা হলো না।
দেয়ালের সঙ্গে ওকে ঠেসে ধরে থাকল দুই যুবক।
প্লিজ, সানজানা! আমার কথা শোনো, আবেদন ঝরল ওর কণ্ঠে। আগের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার কোনোই উপায় নেই?
আছে, কাশল মেয়েটা। যে ঘরে তুমি সবসময় ঘুমাও, অর্থাৎ তোমার অপ্রিয় ওই ছোট্ট রুমটায় একবার ঘুমাতে পারলেই তুমি স্বাভাবিক জীবন…
এত সহজ উপায় থাকতে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছ কেন? ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠল মুসা।
সহজ মনে হলেও আসলে সহজ নয়, কঠিন হাসি ফুটল সানজানার মুখে। তার প্রমাণ এর মধ্যেই তুমি বেশ কয়েকবার পেয়েছ। প্রতিবার তুমি প্রথমে তোমার ঘরেই ঘুমাতে গিয়েছিলে, কিন্তু পরিস্থিতি তোমাকে বাধ্য করেছে গেস্ট রুমে গিয়ে ঘুমাতে। সুতরাং ওই রুমে তুমি কখনও ঘুমাতে পারবে না। এবং স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরেও যেতে পারবে না।
কিন্তু কিন্তু আর একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?
সমস্যা তাতে আরও বাড়বে। বহু কষ্ট করে তোমাকে আটকানো গেছে। কাজেই এখন ছেড়ে দেয়ার ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।
আর কিছু বলার নেই ভেবে চুপ করে থাকল মুসা। মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
আমরা ফিরে আসব, বলল সানজানা। হাসির ভঙ্গি করল। অযথা তুমি ভয় পাচ্ছ। কোনদিক দিয়ে কী ঘটে যাবে, কিছুই টের পাবে না তুমি, দেখো। কোনও ব্যথা লাগবে না।
দরজা বন্ধ করে চলে গেল ওরা। বাইরে থেকে তালা লাগানোর আওয়াজ শোনা গেল।
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘরের চারদিকে নজর বোলাল মুসা। পালানোর পথ খুঁজছে। চারদিকে দেয়াল। উপরে সিলিং। নীচে মেঝে। ছোট্ট একটা জানালা আছে, কিন্তু ওটার গরাদের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া যাবে না। তা ছাড়া। জানালাটাও অনেক উপরে, নাগাল পাবে না ও।
আসলে এটা একটা জেলখানা, বুঝল ও। রিয়্যালিটি পুলিশের জেলখানা।
পাশের ঘর থেকে ওদের অস্পষ্ট কথাবার্তা কানে আসতেই দরজার কাছে। ছুটে গেল মুসা। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল।
ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে ওকে, মিজুর গলা শোনা গেল। পুরো এক গ্লাস খাওয়াতে হবে নইলে ব্যাটা আবার জেগে উঠবে।
কিন্তু যদি বেঁকে বসে? সানজানাকে বলতে শোনা গেল। যদি খেতে না চায়, তখন?
নিশ্চয়ই খাবে! জোর দিয়ে বলল ব্যাবলা। ও খাবে না ওর ঘাড়ে। খাবে। এই দায়িত্বটা আমাকে দাও।
কাঁপতে কাঁপতে দরজার কাছ থেকে সরে এল মুসা। আর শুনতে চায় না। পাগলের মত পায়চারি শুরু করল।
ওরা ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেবে! তা হলে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে ও! কোনওদিন আর ভাঙবে না সে ঘুম!