উঠে দাঁড়াল ও। হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভাঙল। জানালার ওপাশে গাছের ডালে বসে একটা দাঁড়কাক ডাকছে কর্কশ কা-কা শব্দে।
দরজা খোলার চেষ্টা করল মুসা। ওপাশ থেকে বন্ধ। মুখ তুলে জানালার দিকে তাকাল। গরাদের সরু ফাঁকের মধ্য দিয়ে বেরোনো ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
তার মানে পালানোর পথ নেই।
এমন সময় বাইরে থেকে তালা খোলার শব্দ উঠল।
ওরা আসছে!
ঘরের এক কোণে সরে দাঁড়াল মুসা। ভয় লাগছে। ঠোঁট চাটল কয়েকবার।
খুলে গেল দরজা। দুই সঙ্গীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল সানজানা নামের মেয়েটা।
মুসা? আবছা আঁধারে ওকে দেখতে না পেয়ে অনিশ্চিত গলায় ডাকল ও। কোথায়… এক কোণে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেল সে।
আমাকে কেন এখানে ধরে এনেছ তোমরা? স্লান স্বরে বলল মুসা।
ও আবার কথা বলতে পারছে বুঝতে পেরে এই পরিস্থিতিতেও খুশি হয়ে উঠল মুসা। আর যা-ই হোক, অন্তত বিশ্রী গর্জন তো বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে।
আমাকে যেতে দাও!
ছেলেদুটো আপনমনে মাথা দোলাল। যেন ওর আবদার শুনে মজা পেয়েছে।
সে কী! কথা বলে উঠল খাটো জন। যেতে দেব বলে এতদূর ধরে আনা হয়েছে নাকি তোমাকে!
একযোগে এগিয়ে এল দুজন। হাত একবার মুঠো পাকাচ্ছে, একবার খুলছে।
আমাকে যেতে দাও, প্লিজ!
ঝট করে দরজা লাগিয়ে দিল সানজানা।
ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওর দিকে এগোতে লাগল দুই মৃত্যুদূত!
২১
মরিয়া হয়ে ঘরের চারদিকে নজর বোলাতে লাগল মুসা। পালানোর পথ নেই জেনেও পথ খুঁজছে।
দরজার দিকে ছুটতে গেল। কিন্তু হলো না। দরজা আর.ওর মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লম্বু আর বাটকু।
আমরা তোমাকে মারব না, মুসা, শান্ত স্বরে বলল সানজানা। আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই, সত্যি।
আরেক পা এগিয়ে এল ওই দুই তরুণ। সঙ্গে সঙ্গে দুপা পিছিয়ে মাঝখানের দূরত্ব বাড়াল মুসা। সানজানার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। অন্তত ছেলেদুটোর ভঙ্গি দেখে কোনওমতেই মেনে নেয়া সম্ভব নয় যে, ওরা ওকে সাহায্য করতে চায়।
ভয় পেয়ো না, মুসা, সানজানা বলল। তোমার সাথে আমাদের জরুরী কিছু কথা আছে।
হঠাৎ মুসার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মেয়েটা। মুসাকে শান্ত করার আন্তরিক চেষ্টা করছে। মুসাও ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
কিন্তু ছেলেদুটোর মধ্যে আন্তরিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সানজানার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
এসব কী ঘটছে খুলে বলো, প্লিজ, নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টার ফকে বলল মুসা।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল সানজানা। রিয়্যালিটি ওয়ার্প বা বাস্তব ঘূর্ণির মধ্যে আটকা পড়েছ তুমি, তাই তোমার এই অবস্থা।
ওর বলার ভঙ্গি দেখে অবাক হলো মুসা। এমনভাবে বলছে, যেন ব্যাপারটা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রাখে মুসা।
ঠাট্টা করতে ছাড়ল না ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, রিয়্যালিটি ওয়ার্প, হাসির ভঙ্গি করল। আমি জানি এই কারণেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে।
ইয়ার্কি রাখো! ধমক লাগাল লম্বু। এটা কোনও ঠাট্টার বিষয় নয়। আমাদের অনেক ভুগিয়েছ তুমি।
শান্ত হও, ব্যাবলা, ডান হাত তুলল সানজানা। আমি বোঝাচ্ছি ওকে।
মুসার দিকে ঘুরল সে। নরম সুরে বলল, রিয়্যালিটি ওয়ার্ল্ড কী তা তুমি নিশ্চয়ই জানো না, তাই না?
হ্যাঁ, জবাব দিল ও। জানি না। তবে জিনিসটা যে ফালতু কিছু, তা বেশ বুঝতে পারছি।
প্রথম যে রাতে তুমি তোমাদের গেস্ট রুমে ঘুমালে, সে রাতে রিয়্যালিটির একটা গর্তে গিয়েছিলে তুমি।
কিছু বুঝতে না পেরে দুপাশে মাথা দোলাল মুসা।
রিয়্যালিটির গর্ত! আমাদের গেস্ট রুমে!
মাথা ঝাঁকাল সানজানা। এক বাস্তবে ঘুমাও তুমি, জেগে ওঠো আরেক বাস্তবে। অর্থাৎ ব্যাপারটা এরকম
এক হয়ে ঘুমাও, জেগে ওঠো অন্য কিছু হয়ে। এখনও ওই গর্তের মধ্যে আটকে আছ তুমি। এখন তুমি যতবার ঘুমাবে, ততবার বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকবে। বাস্তব হয়ে। যাবে অবাস্তব আর অবাস্তব হবে বাস্তব।
ব্যাপারটা থামিয়ে দাও, তা হলেই তো হয়ে যায়, বলল মুসা।
থামিয়ে দেব! চেঁচিয়ে উঠল বাটু।
আহ্, মিজু, থামো তো! বলল সানজানা।
কিন্তু… কিন্তু… তোমরা… কথা খুঁজে না পেয়ে থেমে গেল মুসা। মাথা ঘুরছে।
তুমি আইন ভঙ্গ করছ, মুসা, বলল সানজানা। যতবার তুমি বদলে যাচ্ছ, ততবারই রিয়্যালিটির আইন ভঙ্গ করছ।
আমি কী ইচ্ছে করে বদলাচ্ছি! প্রতিবাদ করল ও। আর তোমাদের রিয়্যালিটির আইন সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। কাজেই ভাঙার প্রশ্নই আসে না। কী জিনিস সেটা?
আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে করছ না, গলা খাঁকারি দিল সানজানা। কিন্তু সেটা দেখার বিষয় নয়। আইন ভাঙা হচ্ছে, সেটাই আসল। তোমার একেক পরিবর্তনের সাথে সাথে তুমি অনেক মানুষের বাস্তব আর অবাস্তব বোধের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছ। কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব, সেটা তারা বুঝতে পারছে না তোমার কারণে।
তোমরা বুঝতে পারছ না কেন! উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
আমি চাই ব্যাপারটা বন্ধ হোক! এজন্যে যা করার দরকার, করব। আমি আবার স্বাভাবিক জগতে ফিরে যেতে চাই।
চিন্তা কোরো না, দাঁত খিচাল ব্যাবলা। আমরা সব ঠিক করে দেব।
আমরা রিয়্যালিটি পুলিশ, বলল সানজানা। বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দায়িত্ব। তাই প্রথম থেকেই তোমার ওপর নজর ছিল আমাদের। রিয়্যালিটির গোড়ায় কুড়াল মেরে আইনের চোখে বিরাট বড় অপরাধ করেছ তুমি। তোমাকে ধরতেও আমাদের কম বেগ পেতে হয়নি।