এ কী করে হয়?
কালো পোশাক পরা সেই দুই ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মুসা।
ওদের মধ্যে একজন কথা বলে উঠল। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সানজানা। ব্যাটাকে আমাদের কাছে ধরে আনার জন্যে ধন্যবাদ। দারুণ তোমার কর্তব্যজ্ঞান। ধন্যবাদ।
১৯
হা-আ-আ-আ-আ-উ-উ-উ-উ-ম-ম-ম-ম!
দুহাত শূন্যে ছুঁড়ল মুসা পাগলের মত। হিংস্র হয়ে উঠেছে।
সানজানা বিশ্বাসঘাতিনী! বিশ্বাসঘাতকতা করেছে!
পালাতে হবে–ভাবল বিশাল দানবীয় মস্তিষ্কের মধ্যে আটকে পড়া মুসার কচি মন। বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে এই নরক থেকে। নইলে…
আর ভাবার সময় নেই।
দরজার দিকে এগোতে গিয়েছিল মুসা। কিন্তু পারল না।
শক্ত একটা জালের মধ্যে ওকে বন্দি করে ফেলল ওরা।
প্রচণ্ড শক্তিতে চার হাত-পা ছুঁড়তে লাগল মুসা। জাল ছেঁড়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। হলো না। উল্টে আরও পেঁচিয়ে গেল জাল। বেরোবার পথ নেই।
শক্ত নেটের মধ্যে বন্দি হলো মুসা!
দেহের সমস্ত শক্তি এক করে বুক চাপড়াতে লাগল চাপা ক্ষোভে। বন জঙ্গল কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়তে লাগল একের পর এক। কিন্তু লাভ হলো না, এরই মধ্যে শক্ত করে নেটের মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে ওকে।
আমাকে ছেড়ে দাও! বলার চেষ্টা করল ও। তীক্ষ্ণ নখর, দাঁত দিয়ে নেট ছেঁড়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাল আবারও। জালটা অদ্ভুত কোনও জিনিসের তৈরি। ভীষণ মজবুত। ছেঁড়া গেল না কিছুতেই।
তারপরও অনেকক্ষণ পা ছুঁড়ল মুসা। কাজের কাজ কিছু হলো না। মাঝখান থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। মেঝের উপর শুয়ে পড়ল।
এক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে সানজানা এবং কালো পোশাক পরা ছেলেদুটো। চেহারায় স্বস্তি, বিজয়ের আনন্দ।
জানে কাজটা হবে না, তারপরও কেন যেন মুসার মনে হলো ওর পক্ষে কথা বলা সম্ভব। তা-ই মুখ খুলল।
কীভাবে আমাকে এমন বিপদে ফেলতে পারলে তুমি? সানজানাকে বলার চেষ্টা করল। তোমাকে আমি বন্ধু ভেবেছিলাম।
তর্জন-গর্জন ছাড়া কিছুই বেরোল না গলা দিয়ে। মেয়েটা মুখ নীচু করে চেয়ে আছে ওর দিকে। মুসার বক্তব্য বুঝতে পারছে না।
বুকের উপর হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দুই ছেলে। কেমন জব্দ! জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে খাটো ছেলেটা। কথাটা সে-ই বলল।
তোমরা কারা? বলতে চাইল মুসা। কী চাও তোমরা? এসব কী ঘটছে?
জবাব দিল না কেউ।
লম্বা ছেলেটা বলল, অল রাইট। পেছনের রুমে ওকে বন্দি করে রাখি, চলো।
দুর্বল গলায় আবার গর্জন ছাড়ল মুসা। পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে এল ওরা তিনজন। কাজে হাত লাগাল। জালের তিন প্রান্ত ধরে ছ্যাচড়াতে হ্যাঁচড়াতে মুসাকে নিয়ে চলল আরেক ঘরে।
ছোট্ট, অন্ধকার একটা ঘরে নিয়ে এল ওরা মুসাকে। তারপর বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল।
অসহ্য নীরবতা চেপে বসেছে পরিবেশে। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। পাখিরাও ডাকতে ভুলে গেছে।
ঘরের চারদিকে নজর বোলাল মুসা। আবছা আঁধারে দেখা গেল রুমে ও ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই। লোহার গরাদওয়ালা একটা জানালা আছে শুধু অনেক উঁচুতে, সিলিঙের কাছাকাছি। জেলখানার মত।
গরাদগুলো দেখে পেটের খিদেটা চাগিয়ে উঠল। জালের মধ্যে বন্দি না থাকলে এখনই ওগুলো দিয়ে ভোজ সারা যেত। কিন্তু কপাল মন্দ। নেট এত শক্ত হয়ে শরীরে এঁটে আছে যে একচুল নড়তে পারল না মুসা।
বাধ্য হয়ে চুপ করে শুয়ে থাকল ও অসহায়ের মত। কিছু একটা ঘটবার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরও ওরা ফিরে এল না। হয়তো পাশের ঘরেই আছে ওরা, ধারণা করল মুসা। কিন্তু কী করছে বোঝার উপায় নেই।
জানালা দিয়ে দেখা গেল দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে।
সন্ধে নামছে।
মুসা বুঝতে পারছে ঘুমানো ছাড়া এখন কিছু করার নেই ওর। ঘুম থেকে জাগার পর আবার যেন নিজেকে মানুষ হিসেবে ফিরে পায়, এই আশা নিয়ে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ও।
২০
ঘুম ভাঙতেই মুসা টের পেল ব্যথায় জান বেরিয়ে যাবার দশা ওর।
ইয়াল্লা! ভাবল ও। কাল কী খেয়েছিলাম আমি? মনে হচ্ছে ওর পাকস্থলীতে লোহা-লক্কড় নাচানাচি শুরু করেছে।
এমন সময় সব মনে পড়ে গেল।
গাড়ি!
গাড়ি খেয়েছিল ও কাল। ওর পাকস্থলী এখন সত্যিই লোহার টুকরোয় ভর্তি!
ওয়াক! বহু কষ্টে ভিতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা বমির বেগ ঠেকাল মুসা। উঠে বসল। নিজের হাত-পা দেখল।
হ্যাঁ, আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছে মুসা, মানুষ হয়ে গেছে।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল শব্দ করে।
শক্ত জালটা একপাশে পড়ে আছে। কাটা। কী করে ঘটল ব্যাপারটা?
মুসা ঘুমিয়ে থাকতে কেউ এসে কেটে দিয়েছে। কে সে?
কিন্তু আমি এখন কে? ভাবল ও।
সরু সরু হাত-পা, পায়ের পাতা পায়ের তুলনায় বড়ই মনে হচ্ছে। তবে দানবের পাতার মত অত বড় নয়। ও এখন আবার একটা কিশোরে পরিণত হয়েছে। তেরোর আশপাশেই হবে বয়স। একটু বেশিও হতে পারে–চোদ্দ বা পনেরো।
তাতে কিছুই যায়-আসে না। ও এখন আর দানব নেই, সেটাই আসল।
সেটাই একমাত্র স্বস্তির কথা।
কিন্তু এখনও গভীর বনের সেই রহস্যময় বাড়ির মধ্যে ও বন্দি, বুঝতে পারল মুসা। এখনও বন্দি।
অবশেষে সফল হয়েছে রহস্যময় ছেলেদুটো। ওকে ধরতে পেরেছে। তবে সানজানার সাহায্য ছাড়া কাজটা সম্ভব হত কি না সন্দেহ। মেয়েটাকে বন্ধু ভেবেছিল মুসা, সে-ই কিনা…
মুসার কাছে কী চায় ওরা? ওকে নিয়ে কী করতে চলেছে?