উমমমম! দারুণ তো!
ঝটকা মেরে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল ড্রাইভার। চোখ কপালে তুলে বেরিয়ে এল। গলার সমস্ত শক্তি এক করে চেঁচিয়ে উঠল। বাঁচাও! বাঁচাও! বলতে বলতে ছুটল যেদিকে দুচোখ যায়। এদিকে চমৎকার একটা খাবার সামনে পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছে মুসা।
এক টানে একদিকের দরজা ছুটিয়ে ফেলল। ষ্টার হ্যাঁণ্ডেল খুলে মুখে পুরে দিল।
দারুণ তো! ভাবল মুসা। কোঁৎ করে গিলে ফেলল।
এবার কামড়ে দরজার একটা অংশ মুখে পুরে ফেলল।
চাকুম! চাকুম!! চাকুম!!!
রেজরের মত ধারাল দাঁত দিয়ে কড়মড় করে চিবাল মুসা।
মজা পেয়ে চাকুম চাকুম শব্দ করছে। দেখতে দেখতে পুরো দরজা সাবাড় করে ফেলল মুসা। তারপর একটা সিট খুলে নিল। চামড়াটা দারুণ। সুস্বাদু। ফোম প্যাডিং শুকনো হলেও খেতে মন্দ লাগছে না। মাখনবিহীন টোস্ট বিস্কিটের স্বাদ আছে এতে।
স্টিয়ারিং হুইলটা টান মেরে খুলে ফেলতেই একটা সাইরেনের শব্দ কানে এল ওর।
সেরেছে!
সোজা হয়ে সামনে তাকাতে দেখল একটু দূরত্ব রেখে চারদিক থেকে অসংখ্য মানুষ ওকে ঘিরে ফেলেছে।
প্রত্যেকের চোখে-মুখে বিস্ময়, যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে। ভয় তাড়িত কণ্ঠে চেঁচামেচি করছে। সামনে এগোতে চায়, কিন্তু সাহস নেই। মুসার দিকে আঙুল নির্দেশ করে কী সব বলাবলি করছে ওরা।
ইয়াল্লা! বাচ্চা ছেলের মত চেঁচিয়ে উঠল এক মাঝবয়সী লোক। কী ওটা! রাক্ষস নাকি, আস্ত গাড়িটা চিবিয়ে খেয়ে নিচ্ছে!
দানব গাড়ি খাবে না তো কাঁচকলা খাবে নাকি? বিরক্ত হয়ে ভাবল মুসা। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে সাইরেনের শব্দ।
এবার দেখল অসংখ্য পুলিশ ওকে দূর দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।
রাস্তা পরিষ্কার করুন, লাউড স্পিকারে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল। পিছিয়ে আসুন সবাই, সরে দাঁড়ান।
এখনই পালাতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল মুসা, নইলে খবর আছে। স্টিয়ারিং হুইলটা ছুঁড়ে ফেলেই ছুটতে শুরু করল ও। ভয় পেয়ে লোকজন ফোয়ারার পানির মত চারদিকে ছিটকে পড়ে পথ করে দিল ওকে।
থামাও ওটাকে! দানবটাকে ধরো!
পুলিশের কয়েকটা গাড়ি সম্মিলিত সাইরেন বাজাচ্ছে। সে-শব্দে আকাশ কাঁপছে। মুসার কানে তালা লাগার অবস্থা।
পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কপালে খারাবি আছে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। দানব মুসার। নির্ঘাত ওকে মেরে ফেলবে তারা।
পালাতে হবে।
এক্ষুণি পালাতে হবে।
ছুটছে মুসা। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। দৌড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুহাত সামনে-পিছনে করছে। চিৎকার করতে করতে পিছনে ছুটে আসছে জনতার দঙ্গল, পুলিশ বাহিনী। কিন্তু একটা দানবের সঙ্গে পারা সোজা নয়। লম্বা পায়ে দৌড়ে এদের অনেক পিছনে ফেলে দিল মুসা।
মাঝখানে ব্যবধান বাড়ছে ক্রমে।
আরও বাড়ছে!
আরও বাড়ছে!
এক সময় মুসা বুঝতে পারল ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে এসেছে ও। দৌড়াতে দৌড়াতে শহর ছাড়িয়ে নির্জন শহরতলিতে চলে এসেছে। আপনা আপনি দৌড়ের গতি কমে এল।
এবং আচমকা থেমে দাঁড়াল মুসা সামনেই সানজানাকে দেখতে পেল। ওর দিকেই দৌড়ে আসছে মেয়েটা।
মুসার সামনে এসে থেমে দাঁড়াল। ভয় পাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। মেয়েটার মধ্যে, চিনতে পেরেছে হয়তো।
ব্যস্ত হয়ে মুসা কিছু বলার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তাতেই যা বোঝার বুঝে নিল সানজানা। মুসার বাহু ধরে টানতে শুরু করল।
মেয়েটাকে অনুসরণ করল ও।
হাঁটছে।
হাঁটছে।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা গ্রামকে পাশ কাটাল ওরা। মুসার জানতে ইচ্ছে করছে সানজানা ওকে কোথায় নিয়ে চলেছে। কিন্তু জানে কথা বলার ক্ষমতা নেই ওর। কথা বলার চেষ্টা করলে মুখ দিয়ে ভয়ঙ্কর গর্জন বেরিয়ে আসবে। তাতে ভয় পেতে পারে সানজানা। সুতরাং মুখ বুজে ওকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিল মুসা। মেয়েটা নিশ্চয়ই ওর কোনও ক্ষতি করবে না।
হাঁটছে তো হাঁটছেই ওরা।
আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা জঙ্গলের মধ্যে চলে এল ওরা। জঙ্গল ভেদ করে এগিয়ে চলল। যত এগোচ্ছে, তত গম্ভীর হচ্ছে অরণ্য।
সানজানার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মুসার অন্তর। যা বোঝার বুঝে নিয়েছে সে। মেয়েটা ওকে লোকচক্ষুর আড়ালে গভীর বনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চাইছে হয়তো।
সরু, জংলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে দুজন। সামনে সানজানা, পিছনে মুসা। একটু পরপর মেয়েটা পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। মুসা ওকে অনুসরণ করছে কি না দেখে নিচ্ছে।
অবশেষে ছোট, পাকা একটা পুরানো বাড়ির সামনে শেষ হলো ওদের দীর্ঘ পথচলা। গাছপালা বাড়িটাকে ঢেকে রেখেছে প্রায়। দূর থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই।
লুকানোর চমৎকার জায়গা এটা, ভাবতে গিয়ে খুশি হয়ে উঠল মুসা। কিন্তু সানজানা এটার খবর কীভাবে জানল ভেবে অবাকও হচ্ছে যথেষ্ট। হয়তো এই গ্রামে ওদের আসা-যাওয়া আছে। হয়তো কোন আত্মীয় থাকেন।
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বাড়িতে দিব্যি মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু খাবার? খাবার কোথায় পাবে মুসা?
খাওয়ার কথা মনে হতেই পেটের ভিতরে নতুন করে মোচড় দিয়ে উঠল। তবে ব্যাপারটাকে পাত্তা দিল না মুসা।
এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল সানজানা। মুসাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
তখনই ওদের সামনে এসে দাঁড়াল দুটো ছায়া।
প্রথমে ছায়াই মনে করেছিল মুসা।
পরমুহূর্তে ভুল ভাঙল।
ছায়া কোথায়, মানুষ!
কালো পোশাক পরা!
ওদের দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল মুসা।