কিন্তু কথা নয়, কলজে পানি করা হুঙ্কার বের হলো গলা দিয়ে। মনের ভীষণ চাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল।
না! ভয়ে কাঁটা দিল মুসার সারা গায়ে। ভিনগ্রহের আজব এক জম্ভর মত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে এখন ওকে। এমন কী কথা পর্যন্ত বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে।
বিশাল দেহ পেয়েছে মুসা। উচ্চতা কম করে হলেও সাত ফুট হবে–গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। চামড়ার রং সবুজ, তার মধ্যে কালো স্ট্রাইপ। অনেকটা রাস্তার জেব্রা ক্রসিঙের মত। বাতাসে ভেসে বেড়ানো নানান শব্দ আসছে কানে। ঘ্রাণশক্তিও অনেক বেড়ে গেছে। অনেকটা কুকুরের মত।
ভিনগ্রহের কুৎসিত প্রাণীর মত লাগছে ওকে দেখতে। নাক-মুখ-চোখ কান সবই আছে। চোখদুটোর সাইজ কমলালেবুর সমান। বোচা নাক। জঘন্য! সরু, চোখা কান।
হাতের আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা–সেগুলোর আগায় লম্বা নখ। দেখে গা ঘিঘিন করে উঠল মুসার।
এর চেয়ে বুড়ো হয়ে থাকাও অনেক ভাল ছিল। যতবার ও ঘুম থেকে জাগছে, ততবারই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ কী অসহ্য যন্ত্রণায় পড়ল। মুসা?
এর শেষ কোথায়?
কী করে এর হাত থেকে মুক্তি মিলবে?
সানজানার কথা মনে পড়ল মুসার। ও নিজে যে জগতেই থাকুক, ভোজবাজির মত উদয় হয় মেয়েটা। এবং এ পর্যন্ত প্রতিবারই কালো পোশাক পরা বিপজ্জনক দুই তরুণের হাত থেকে বাঁচানোর ব্যাপারে ওকে সাহায্য করেছে মেয়েটা। সানজানা আসলে ওকে সাহায্য করতে চায়। সেই জন্যই বারবার আসে?
যেভাবে হোক, ওকে খুঁজে বের করতে হবে
সিদ্ধান্ত নিল মুসা। মন বলছে ওকে খুঁজে বের করা সম্ভব। মেয়েটা ওর ধারেকাছেই কোথাও আছে। গত কদিনের কথা ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছল মুসাহা, সানজানা ওকে উদ্ধার করতেই চায়। নিশ্চয়ই ও কোনও বিশেষ মেয়ে হবে। কাজেই সানজানাই এখন ওর একমাত্র ভরসা।
বিশাল দানবীয় শরীর নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াল মুসা।
ফাঁকা। জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। খাঁ-খাঁ করছে বাড়িটা। ওকে সাহায্য করার কেউ নেই।
মুসা ভেবেছিল এখন ও হয়তো কোনও দানব-পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে। দানব বাবা-মা, ভাই-বোন আছে হয়তো।
কিন্তু না, বাড়িতে ও ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই।
মনে মনে খুশি হয়ে উঠল মুসা। এ বরং ভালই হয়েছে। এখন ও যা খুশি তাই করতে পারবে। বাধা দেয়ার বা শাসন করার মত কেউ নেই।
ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এল মুসা। চেঁচিয়ে ডাকার চেষ্টা করল, সানজানা! সানজানা, তুমি কোথায়?
কিন্তু কোনও কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। যা বেরোল তা রক্ত ঠাণ্ডা করা দুর্বোধ্য হুঙ্কার।
আচমকা ওর সামনে ব্রেক কষল একটা গাড়ি। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিল ড্রাইভার। চোখ আলু করে চেয়ে থাকল মুসার দিকে।
ভয় পাবেন না! চেঁচিয়ে উঠল ও। কিন্তু গলা দিয়ে ফুটল অন্য কিছু, কথা নয় আকাশ বাতাস কাঁপানো এক গর্জন।
প্রথমে একটা চিৎকার দিল ড্রাইভার। তারপর গাড়ির গতি দ্রুত তুলল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না, আরেকটা গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটিয়ে বসল। ইস্পাত ও কাঁচ ভাঙচুরের ভয়াবহ আওয়াজ হলো।
কেউ আহত হয়েছে কি না দেখার জন্য এগোল মুসা। অন্য গাড়িতে এক মহিলা আর এক শিশুকে দেখা গেল।
না, আঘাত পায়নি কেউ। তবে গাড়ি দুটোর বেশ ক্ষতি হয়েছে।
চোখের সামনে অদ্ভুত প্রাণীটাকে দেখতে পেয়েই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল সবাই। চিৎকার করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল যে যেদিকে পারে।
এগিয়ে চলেছে মুসা। ওর প্রত্যেক পদক্ষেপে মাটি কেঁপে উঠছে। রাস্তার লোকজন থমকে দাঁড়াচ্ছে, বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকছে কয়েক মুহূর্ত, তারপর রুদ্ধশ্বাসে উল্টোদিকে ছুটছে। দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছে চোখের আড়ালে।
সানজানা, ভাবছে মুসা, সানজানাকে খুঁজে বের করতেই হবে যে-করে হোক।
মাথার মধ্যে কেবল সানজানার চিন্তা ধরে রাখতে চাইছে মুসা। কিন্তু এ পারছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব।
খিদে!
প্রচণ্ড খিদেয় পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি মোচড় মারছে। প্রিয় খাবারগুলো ওর চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু ওগুলো তো কোনও দানবের খাবার হতে পারে না। ওর এখন দরকার শক্ত, কঠিন খাবার।
একটা গাড়ি খেয়ে দেখলে মন্দ হত না–ভাবল মুসা। নিশ্চয়ই খুব মজার, সুস্বাদু হবে।
ওদিকে হুলস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। হই-চই, চেঁচামেচিতে মুসার দানবীয় কানেও তালা লাগার দশা। লোকজন যে-যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। চারদিকে মহা বিশৃঙ্খলা।
যাজকের পোশাক পরা এক লোককে বলতে শোনা গেল, পৃথিবী শেষ! এসব পৃথিবী শেষ হওয়ার লক্ষণ!
বলে আর দাঁড়াল না লোকটা। ঘুরেই দিল দৌড়।
মানুষ যতই ভয় পাক, কাউকে আঘাত করার ইচ্ছে নেই মুসার। সানজানাকে খুঁজছে ও। ভীষণ দরকার এখন মেয়েটাকে।
কিন্তু তার আগে পেট ঠাণ্ডা করতে হবে। খিদেটা ভীষণ চাগিয়ে উঠেছে।
দানবীয় পা ফেলে একটা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মুসা। ঝকঝকে নতুন গাড়ি। ওটা দেখেই দ্বিগুণ বেড়ে গেল খিদে। পানি এসে গেল জিভে।
দানবীয় হাত দিয়ে গরিলার যুদ্ধ ঘোষণার মত দমাদম নিজের বুক চাপড়াতে লাগল মুসা।
তাই দেখে গাড়ির ভিতরে বসা ড্রাইভার থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। কী করবে দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। সামনে-পিছনে কোনওদিকেই যাওয়া চলবে না। রাস্তায় অজস্র গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে।
একটা ওয়াইপার টান দিয়ে খুলে ফেলল মুসা। স্বাদ পরীক্ষা করে দেখা দরকার।