টু করে বেরিয়ে এল মুসা। চেয়ে চেয়ে দেখল কেবল হারকিউলিস।
চুপি চুপি তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল ও। যে ভ্যানে করে এসেছিল, সেটায় উঠে বসে থাকল। আর সবার প্র্যাকটিস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকল। অনেকক্ষণ পর ফিরল ওর নতুন পরিবারের সদস্যরা। ওকে ভালমানুষের মত গাড়িতে বসে থাকতে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন বাবা।
সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?
জবাব দিল না ও। ভ্যানে উঠে পড়ল সবাই। বাড়ির পথে চলতে শুরু করল লক্কর-ঝক্কর গাড়ি।
সামনে মা-বাবার মাঝখানে বসেছে মুসা। নইলে বোনেরা ওকে খুঁচিয়ে শেষ করে দিত।
আমার খুব খারাপ লাগছে, অভিযোগের সুরে বলল মুসা। ঘুমানো দরকার।
কাল আবার প্র্যাকটিসে আসতে হবে মনে থাকে যেন, গাড়ি চালনার ফাঁকে মাথা দোলালেন বাবা। কাল কিন্তু কোনও ওজর-আপত্তি চলবে না ॥ বলে দিলাম।
জবাব দেয়ার বদলে হাই তুলল মুসা। ও জানে কাল কখনও আসবে না। অন্তত এই সার্কাস-পরিবারের সদস্য আর থাকবে না ও কাল।
কাল নতুন এবং হয়তো আরও ভীতিকর পরিবেশ এসে হাজির হবে ওর সামনে। অথবা ভাল কিছুও ঘটতে পারে। সেই আশাই করছে ও।
খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি বিছানার দিকে এগোল মুসা। আট বছরের ছোট থাকতে একদম ভাল লাগছে না। তার উপর এই সার্কাস-পরিবার একেবারে অসহ্য ঠেকছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পরিবারের হাত থেকে উদ্ধার পেতে চায় ও।
ওর রুমে বাদরামি করছে ভাই-বোনেরা। সুতরাং আবার সেই গেস্ট রুমেই যেতে হলো ওকে বাধ্য হয়ে।
শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে কেবল, ঘুমাতে পারছে না। নানান চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে আছে, ঘুরছে।
কাল ওর জন্য নতুন কী চমক আসছে, সে কথা ভাবছে।
পাঠক, তোমরা যদি ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে পড়তে যদি জানতে, আগামীকাল ঘুম থেকে ওঠার পর নতুন কোনও পৃথিবীর বাসিন্দা হবে তুমি, অথচ সেই পৃথিবীটা কেমন হবে তা তোমার জানা নেই, তা হলে তুমি কী ঘুমাতে পারতে?
না মনে হয়।
মুসাও ঘুমাতে পারছে না।
আগামীকাল উঠে যদি দেখি আমি ফুটবল প্লেয়ার হয়ে গেছি, কী যে দারুণ হত! ভাবল ও। যদি পৃথিবীর সেরা ফুটবল প্লেয়ার হতে পারতাম ম্যারাডোনা বা প্লাতিনির মত!
অথবা কোটিপতি কোনও বাবা-মার সন্তান! যা চাইতাম, তাই পেতাম, দারুণ ব্যাপার হত!
অথবা পাঁচশো বছর ভবিষ্যতে যাওয়া যেত যদি! অথবা যদি একজন মহাকাশচারী হতে পারতাম!
মুসা জানে এসব কিছুই ঘটবে না। কারণ ওর কপাল খারাপ। অন্তত এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তাতে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
সবকিছুকে ছাপিয়ে আসল পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা ওর মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
সেদিন কী আসবে আর কখনও?
ওর আসল পরিবারে ফিরে যেতে পারবে মুসা? বাবা, মা, ফারিহা, তানজিয়া, শাওনি ভাইকে ফিরে পাবে? মনে হলো কতযুগ যেন ওদের দেখে না।
খারাপ লেগে উঠল মুসার।
অবশেষে ভোরের দিকে দুচোখ বুজে এল ওর।
.
যখন ঘুম ভাঙল, তখনও আলো ভালমত ফোটেনি। ঘুমজড়ানো চোখে রুমের চারদিকে নজর বোলাল মুসা।
এখন আমি কে? ভাবল। ঘরটা তো স্বাভাবিকই আছে মনে হচ্ছে। বাড়ির ভিতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। সার্কাস-পরিবার গায়েব হয়ে গেছে বুঝতে অসুবিধে হলো না মুসার।
লাফ দিয়ে উঠে বসল। নেমে দাঁড়াল বিছানা থেকে। দুপা ভীষণ দুর্বল লাগছে।
ব্যাপার কী?
ধীর পায়ে বাথরুমের দিকে এগোল মুসা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যা দেখল, তাতে মাথা ঘুরে উঠল বন্ন করে।
হায় আল্লা!
আজকে আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে মুসা।
এ অসম্ভব!
অকল্পনীয়!
অবিশ্বাস্য।
১৭
মুসা এখন থুথুড়ে এক বুড়ো!
না! দুর্বল কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করল ও। এ হতে পারে না!
এ মেনে নেয়া যায় না।
কিছুতেই না।
বুড়ো হয়ে বাঁচতে চায় না মুসা।
এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।
দুর্বল পায়ে গেস্ট রুমে ফিরে এল ও। মনে হচ্ছে একেকটা পায়ের ওজন কয়েক মণ করে বেড়ে গেছে। সহজে তোলা যায় না।
রুমে এসে বিছানায় বসে কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল মুসা, যেন কয়েক মাইল পথ দৌড়ে এসেছে। টপটপ করছে হৃৎপিণ্ড।
শুয়ে চোখ বুজল।
আবার ঘুমাতে হবে। বুড়ো হয়ে বাঁচতে চায় না ও কিছুতেই। ওর বয়স এখন মাত্র তেরো, জানে মুসা। কাজেই এত তাড়াতাড়ি বুড়ো হতে চায় না ও।
এবং ঘুমানো ছাড়া এই বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও পথ নেই। একসময় ঘুমিয়ে পড়লও মুসা। যখন জেগে উঠল, টের পেল বদলে গেছে ও। এখন আর বুড়ো নেই।
আগের মত দুর্বল লাগছে না। বরং ভিতরের শক্তি অনেক বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। হয়তো এখন আমি একজন ফুটবল খেলোয়াড়, আশান্বিত হয়ে ভাবল ও।
উঠে বসে চোখ ডলল কয়েক মুহূর্ত। আচমকা হাতের দিকে নজর যেতেই আঁতকে উঠল।
ওর চামড়া সবুজ হয়ে গেছে!
সবুজ কেন?
আর আঙুলগুলোই বা অমন অদ্ভুত কেন? মানুষের আঙুল অমন হয় নাকি?
জোরে জোরে শ্বাস টানল ও। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপছে। বুকের খাঁচায় বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড।
এবার কী ঘটেছে ওর পোড়া কপালে?
একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বাথরুমে চলে এল মুসা। আয়নার সামনে দাঁড়াল। এবং যথারীতি সশব্দে আঁতকে উঠল নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।
দানব হয়ে গেছে মুসা!
কুৎসিত, ভয়ানক এক দানবে পরিণত হয়েছে ও!
১৮
গলা দিয়ে আপনাআপনি একটা গোঙানি ঠেলে বেরিয়ে এল।
এ হতে পারে না, মরিয়া হয়ে বলবার চেষ্টা করল ও। কিছুতেই না।