মরিয়া হয়ে খিচে দৌড় লাগাল মুসা! মাথা ঝিমঝিম করছে ওর। ভিতর থেকে কেউ যেন বলছে, জলদি লুকাও, মুসা। বাঁচতে চাইলে শীগগির কোথাও লুকিয়ে পড়ো।
তবু থেকে বেরোতেই সামনে একটা পার্কিং লট দেখতে পেয়ে সেদিকেই এগোল মুসা। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
একটার আড়ালে পৌঁছে থেমে পড়ল। এবং পরমুহূর্তে সানজানার সাথে ধাক্কা খেল।
তুমি! মেয়েটাকে দেখে বিস্মিত হলো মুসা। পরমুহূর্তে বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে সচকিত হয়ে উঠল। বাবা এখনই এসে পড়লেন বলে। আগে জান, বাঁচানো ফরজ।,
আমাকে কোথাও লুকাতে হবে, সানজানা, রুদ্ধশ্বাসে বলল মুসা। মহাবিপদে পড়েছি।
বিপদ! কীসের বিপদ?
সিংহের খাবার হতে চলেছি আমি, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল ও আমাকে বাঁচাও, সানজানা!
একটা গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করল সানজানা। খুলল না, লক করা।
হায় আল্লা! আচমকা চাপা গলায় গুঙিয়ে উঠল মুসা। সানজানা, ওই দেখো!
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল মেয়েটা। কালো পোশাক পরা গতকালকের সেই দুই তরুণ ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে অমোঘ নিয়তির মত।
ভুল হলো। ওদের দিকে নয়, মুসার দিকে!
ভাবার সময় নেই। ঝেড়ে দৌড় লাগাল মুসা। কিন্তু কোথায় যাবে? কোথায় লুকাবে?
লুকানোর জায়গা নেই।
না, আছে। তাঁবু। সার্কাসের তাঁবু।
কালো পোশাক পরা ওই দুটো ছেলের চেয়ে এখন সিংহটাকেও অনেক নিরাপদ মনে হচ্ছে ওর। অগত্যা তাঁবুতেই আবার ঢুকে পড়ল মুসা।
তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে ও! চেঁচিয়ে উঠল লম্বা ছেলেটা।
এবার ব্যাটাকে পালাতে দেয়া যাবে না, বলল খাটোটা। চলো, আমরাও ভেতরে যাই।
ঢুকে পড়ল ওরা।
ওদিকে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে মুসা। এমন শেয়াল-দৌড় ও জীবনে দৌড়েছে। কিনা সন্দেহ। সোজা সিংহের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। যে-জায়গাটাকে একটু আগেও যমের মত ভয় পাচ্ছিল ও, সেটাকে এখন নিরাপদ মনে হতে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
১৫
তারপর আগুপিছু চিন্তা না করেই খাঁচার দরজা লাগিয়ে দিল।
এদিকে দুই কালো পোশাক পরা তরুণ এসে পড়েছে। খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল ওরা। নিজেদেরকে সুস্থির হওয়ার সময় দিল। তারপর ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল মুসার দিকে।
এবার? কোথায় পালাবে, বাছাধন? কোমরে হাত রেখে মাথা ঝাঁকাল একজন।
চারপাশে দ্রুত নজর বোলাল মুসা। বাবা নেই। খাঁচায় সে একা। হারকিউলিসের সাথে। রাগে গরগর আওয়াজ করছে ওটা।
রাগ করিসনে, বাপ! শান্ত হ… ওটার উদ্দেশে বিড়বিড় করে বলল মুসা। কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। খাঁচার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আগের মতই গজরাচ্ছে পশুরাজ।
রহস্যময় ছেলেদুটো খাঁচার দরজা ধরে মরিয়া হয়ে ঝাঁকাতে শুরু করল। খুলে গেল দরজা। টুক করে ভিতরে ঢুকে পড়ল ওরা।
পালানোর চেষ্টা কোরো না, লম্বু সতর্ক করল।
এত মানুষ দেখে হুঙ্কার দিল সিংহটা। সার্কাসের বুড়ো সিংহ, অন্যজনকে বলতে শুনল মুসা। এ একটু বেঁটে। আমাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই ওর!
কিন্তু মুখে যাই বলুক, ওদের ভিতরের ভয় মুসার চোখে ধরা পড়ে গেল। যতই বাহাদুরি ফলাক, ভিতরের অস্বস্তির ভাবটা চেহারায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।
আরেক হুঙ্কার ছাড়ল হারকিউলিস–আগের চেয়ে জোরে। সামনে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা।
মুসা পিছিয়ে গেল।
সিংহটার ওপাশে আড়াল নেয়ার ইচ্ছে আছে। ওর আর বদমাশ দুটোর মাঝখানে যদি সিংহটা থাকে, ওরা এগোতে সাহস করবে না।
লঘু সতর্ক পায়ে সামনে এগোতে শুরু করল। এবার ওর দিকে তাকিয়ে। হুঙ্কার ছাড়ল হারকিউলিস।
ঘাবড়ে গেল ছেলেটা, যতটুকু এগিয়েছিল, তার চেয়েও পিছিয়ে গেল।
ওদের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে মুসার দিকে তাকাল হারকিউলিস। মনে হয় বোঝার চেষ্টা করছে কার মাংস বেশি সুস্বাদু হবে।
বাঁচতে চাইলে বেরিয়ে যাও তোমরা, গলায় জোর ফোঁটানোর চেষ্টা করল ও। আজ এখনও পর্যন্ত হারকিউলিসকে খেতে দেয়া হয়নি। ওটা কিন্তু ক্ষুধার্ত।
ভয়ে ভয়ে ওটার দিকে তাকাল দুই বদমাশ।
হারকিউলিস আমাকে কিছু করবে না. সির ভঙ্গি করল মুসা। কারণ আমি ওর মাস্টার। আমি হুকুম করলে ও তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
নজর বিনিময় করল ওরা। দুর্বল গলায় একজন বলল, মিথ্যে কথা!
অন্যজনের চেহারায় অনিশ্চয়তা।
সত্যি! তোমরা চাইলে প্রমাণ করে দেখাতে পারি।
বাঁটু পিছিয়ে গেল। লম্বু ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এল সামনে। ভয় পাচ্ছ কেন! বিড়বিড় করে বলল। ঘোড়াটা আমাদের বোকা বানাতে চাইছে।
হারকিউলিস! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ধরো ওদের… ওর কথা শেষ হবার আগেই এমন এক হুঙ্কার ছাড়ল পশুরাজ, মাটি থরথর করে কেঁপে উঠল।
না, ঝাঁপিয়ে পড়বার দরকার পড়ল না হারকিউলিসের। তার আগেই লেজ, তুলে দৌড় লাগাল ছেলেদুটো। চোখের পলকে খাঁচা থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল।
ঠিক আছে, হুমকির সুরে লম্বু বলল। যাচ্ছি। কিন্তু তাই বলে মনে কোরো না তুমি পালাতে পারবে। আবার আসব আমরা! তোমাকে শায়েস্তা করে ছাড়ব।
কি চাও তোমরা আমার কাছে? কণ্ঠ কেঁপে গেল মুসার। আমি কী দোষ করেছি? বলো, কী দোষ করেছি আমি? কেন পিছু লেগেছ আমার?
১৬
আসলে কাউকেই খাওয়ার আগ্রহ ছিল না হারকিউলিসের। কারণ ওটা মানুষখেকো নয়। মাংস খায় ঠিকই, কিন্তু সেসব ওটার প্রতিদিনের রেশনের মাংস, তাজা মানুষের নয়। খাঁচা থেকে বেরোতে চাইছে ওটা আসলে, বন্দিদশা থেকে মুক্তি চায়। এই জন্যই রাগ ঝাড়ছে।