আমাকে কী করতে হবে? ভাবল মুসা। ওর দুই বোন একটা মই বেয়ে তর তর করে বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেল। তারপর সিলিং থেকে নেমে আসা দুই দড়ির মাথায় ঝুলন্ত আড়া ধরে দুলতে শুরু করল অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে। তাই দেখে আত্মা উড়ে গেল মুসার।
ওই কাজ ওর দ্বারা কোনওদিনই সম্ভব না। হার্টফেল করবে ও নির্ঘাত।
এসো, মুসা, তাড়া লাগালেন বাবা। কাজে চলো।
তাকে মই রেখে সামনে এগিয়ে যেতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। ওকে তা হলে দড়ি ধরে ঝুলতে হচ্ছে না।
বাঁচলাম! ভাবল সে সামনে এগোতে এগোতে।
না, বাঁচেনি।
ভুলটা একটু পরেই ভাঙল মুসার।
ওকে নিয়ে বাবা তাঁবুর পিছনদিকে চলে এলেন। অনেকগুলো জীব জন্তুর খাঁচা দেখে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল মুসা।
একটা খাঁচার দরজা খুলে দিলেন বাবা।
এসো, মুচকি হেসে বললেন। ঢুকে পড়া।
চোয়াল ঝুলে গেল মুসার। চোখ আলু করে সামনে চেয়ে রইল। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করা যাবে না।
ব-ব-বলেন কী! দুর্বল গলায় ইঁদুরের মত কিচকিচ্ করে উঠল ও। ভে ভেতরে তো সিংহ!
বিশাল এক হাঁ করে এমন এক গর্জন ছাড়ল সিংহটা, সারা তাঁবু কেঁপে উঠল। থরথর করে কেঁপে উঠল মুসাও। কাঁপা পায়ে কোনওমতে দুপা পিছাল।
তাতে কী? ভয় নেই, এসো। ভয় পেয়ে দূরে সরে থাকলে কোনওদিন ওকে বশ করতে পারবে না তুমি। এসো।
নড়তে পারল না মুসা।
শক্তি আছে নাকি যে নড়বে!
বাবা ওকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলেন খাঁচার মধ্যে। এবং পরমুহূর্তে দরজা লেগে গেল দড়াম করে।
১৪
খাঁচার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল মুসা। ঠাণ্ডা স্টীল বারের ছোঁয়ায় দ্বিগুণ বেড়ে গেল কাঁপুনি। ভয়ে চোখ উল্টে যারার দশা। পা এত জোরে কাঁপছে যে ভয় হলো মুখ থুবড়ে পড়েই যাবে যে-কোন মুহূর্তে।
সিংহটা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। দৃষ্টিতে আগুন ঝরছে যেন।
ওর বাবা লায়ন টেমার, কখন খাঁচায় ঢুকেছেন খেয়াল করেনি মুসা। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন উনি, হাতে চাবুক। তাই দেখে কিছুটা ভরসা হলো।
নতুন একটা ট্রিক শিখব আজ আমরা, বললেন উনি হাসতে হাসতে, যেন ব্যাপারটা খুবই মজার। ওটার পিঠে চড়বে তুমি।
ছেলেকে সামনে ঠেলে দিলেন বাবা।
এই মরেছে! তাজ্জব হয়ে ভাবল মুসা। ভদ্রলোক ওর সঙ্গে ঠাট্টা করছেন নাকি? মানুষ চড়বে সিংহের পিঠে? কাঁপাকাপি বেড়ে গেল ওর।
হে খোদা! বাঁচাও আমাকে। এ কীসের মধ্যে এনে ফেললে আমাকে?।
এ কেমন ধরনের বাবা? ভাবল মুসা কাঁপতে কাঁপতে। নিজের ছেলেকে সিংহের খাবার বানাতে চলেছেন!
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পশুরাজ। নড়াচড়ার কোনও লক্ষণ নেই। মুসাও স্থির। এক দৃষ্টিতে ওটার দিকে চেয়ে আছে। দুচোখ আলু হয়ে আছে।
আচমকা এমন এক হাঁক ছাড়ল ওটা, সারা এলাকা থরথর করে কেঁপে উঠল। আরেকটু হলে হার্টফেলই করে বসত হয়তো মুসা।
ওটার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ল ওর মুখের উপর। আতঙ্কে ঘাড়ের খাটো খাটো চুল সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেল।
নড়ে উঠল পশুরাজ। মুসার দিকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে শুরু করল। হাতের চাবুক দিয়ে মেঝেতে জোর এক বাড়ি লাগালেন বাবা। পরমুহূর্তে গলা ছেড়ে হেঁকে উঠলেন, হেইয়া!
ঠোঁট চাটতে চাটতে পিছাতে শুরু করল পশুরাজ।
সামনে যাও, মুসা, হুকুম দিলেন বাবা। উঠে পড়ো হারকিউলিসের। পিঠে। শক্ত করে কাধ ধরে থাকবে, নড়াচড়া করবে না। আমার চাবুকের বাড়ির তালে তালে দেখো কী সুন্দর খাঁচার চারদিকে ঘুরে বেড়ায় ওটা তোমাকে নিয়ে। এগোও, জলদি।
কথা জোগাল না মুসার মুখে। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে লোকটার দিকে চেয়ে আছে।
উজবুকের মত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছ কেন আমার দিকে? হারকিউলিসকে তুমি একটুও ভয় পাও না। কী বলো, পাও?
না, মোটেই না। একশো পারসেন্ট সত্যি বলেছেন আপনি, ভাবল মনে মনে। হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেল না, তো? এসব কী বলছেন? বেশিরভাগ সময় জন্তু-জানোয়াররা ওকে খুব পছন্দই করে, কিন্তু তাই বলে সিংহের মত এরকম হিংস্র একটা প্রাণী…
চাবুক চালালেন উনি। আমি জানি–আমার ছেলে ভীতু হতে পারে না, গম্ভীর গলায় বললেন তিনি। যা বলছি জলদি করো, যাও!
পরমুহূর্তে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস্ করে বললেন, অযথা ভয় পাচ্ছ তুমি, মুসা। হারকিউলিস খুব ভাল। এখন পর্যন্ত কাউকে একটা আঁচড়ও দেয়নি। তোমাকেও দেবে না।
ঠিক ওর পায়ের কাছে চাবুকের বাড়ি মারলেন আবার। যাও!
কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? সত্যি যদি ও সার্কাস-পরিবারের সদস্য হত, তা হলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু এ কেমন কথা? ঘুম থেকে জেগে দেখল। সে এমন একটা পরিবারের ছেলে, আর কথা নেই বার্তা নেই ‘বাবা’ ওকে টেনে-হিঁচড়ে সিংহের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিলেন।
স্বপ্নেও ভাবা যায়?
মুসা যে এখনও ধড়ে প্রাণ নিয়ে দুপায়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্যান্ট-ট্যান্ট ভিজিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে বসেনি, তা-ই তো বেশি।
চিন্তার ঝড় বইছে মুসার মাথায়। আর একমুহূর্তও এই খাঁচায় থাকতে ইচ্ছে করছে না। প্রাণে বাঁচতে চাইলে পালাতেই হবে। সিংহের পিঠে ওঠার আগেই হয়তো হার্টফেল করবে ও।
আবার চাবুক হাঁকালেন বাবা। লাফিয়ে পিছিয়ে গেল মুসা।
একটানে দরজা খুলেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। কোনদিক দিয়ে কী ঘটে গেল কিছুই বুঝতে পারলেন না ওর বাবা।