ওই মহিলা এখন নিশ্চয়ই ওর মা–ভাবল মুসা।
অনেকগুলো পিচ্চি হাউকাউ করছে। বাঁদরের মত লাফালাফি করছে সারাবাড়ি। বিভিন্ন বয়সের, মনে হচ্ছে এক ডজনের কম হবে না। না, গুনে দেখা গেল ছয়টা। আধ ডজন। তাই বা কম কীসে?
নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে নিরুপায় মুসা। ওর নিজের বয়স আট। ছয়-ছয়টাবোন ওর এখন, এবং একটা পোষা বানরও আছে এ পরিবারে। অদ্ভুত নাম-ক্যাস্টেম। মাকে অবশ্য এখনও দেখেনি ও–তবে বাবাকে যেটুকু দেখেছে; তাতেই কাজ হয়ে গেছে। ভীষণ হতাশ হয়েছে মুসা। অমন উজবুক মার্কা পোশাক পরা এক লোক ওর বাবা–চিন্তা করা যায়?
এবং ওকে পরার জন্য যে পোশাক দেয়া হয়েছে, সেটাই বা কম যায় কীসে? ব্যায়ামবিদ বা নাচের শিল্পীরা কোমরের কাছে যে জোড়া.দেয়া ওয়ান পীস, আঁটসাঁট পোশাক পরে, ঠিক তেমনি এক টাইট আউটফিট। ওটার বিচ্ছিরি রং চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। নীচের অংশ ক্যাটকেটে নীল, তার উপর সাদা স্ট্রাইপ। উপরের অংশে নীলের ওপর বড় বড় সাদা তারা ফুটে আছে। সব মিলে কী বিচ্ছিরি!
এই জঘন্য পোশাক কেন পরতে হবে ওকে?
কীসের রিহার্সালের কথা বললেন ওর বাবা?
কোনও নাটকে অভিনয় করতে হবে? ভাবতে গিয়ে কলজের পানি শুকিয়ে বরফ হয়ে উঠল। নাটকে অভিনয়ের কথা কল্পনাও করতে চাইছে না মুসা। ওর ধারণা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ ওটা। অভিনেতাদের অতিমানব মনে হয়, তা না হলে কীভাবে ওরকম কঠিন কাজটা করেন তারা?
ভাবতে ভাবতে কস্টিউম পরে নিল মুসা। অবাক হয়ে খেয়াল করল, শরীরে এমনভাবে ফিট হয়েছে ওটা, দেখে মনে হচ্ছে মুসার দ্বিতীয় চামড়া বুঝি। একেবারে জোকারের মত লাগছে ওকে দেখতে।
ধীর পায়ে কিচেনের দিকে এগোল ও।
কিচেন তো নয়, যেন মাছের বাজার। বাঁদরামি করছে হাফ ডজন পিচ্চি। এ ওকে গুতো মারছে, ও তাকে চাটি মারছে। খাবার ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। হাউকাউ, হাসাহাসি
সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড!
লম্বা, একহারা গড়নের এক মহিলা প্লেটে পাউরুটি সাজাচ্ছেন। মাথায় মেঘের মত ঘন, লম্বা চুল। পরনে টকটকে লাল একটা ম্যাক্সি।
আমার নতুন মা, ভাবল মুসা।
একটা প্লেট টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করল।
সুপার হিরোর পোশাকে মুসাকে আজ দারুণ কিউট লাগছে, তাই না? খোঁচা লাগাল এক মেয়ে। ওর বড় বোনদের একজন হবে হয়তো।
একদম বাদরের মত লাগছে, দাঁত বের করে বলল এক ছেলে, ভাই বোধহয়। মুসার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে হয়তো। ক্যাস্টেমের বড় ভাইয়ের মত, বলে হাসিতে ফেটে পড়ল ছেলেটা। ওর চিবুকে এত জোরে এক ঠোকা মেরে বসল যে মাথার ভিতরে খবর হয়ে গেল মুসার। কিউট লিটল মুসা, বলে চলেছে সে, খুদে সার্কাস-তারকা।
সার্কাস!
মুখ থেকে রুটির টুকরো পড়ে গেল মুসার। সর্বনাশ! এ কী শুনছে ও? সার্কাস! কীসের সার্কাস? কয়েকবার সার্কাসে কাজ করেছে ও। তা-ই বলে এখন ও পেশাদারি ভাবে…
মাথা ঘুরতে শুরু করল মুসার।
অদ্ভুত কস্টিউম।
বানর।
হ্যাঁ, এতক্ষণে এসবের কারণ একটু একটু খোলাসা হতে শুরু করেছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরল মুসা। সাহেবুল সুলতান মুসা, সার্কাস বয়! গলা ছেড়ে যদি কিছুক্ষণ ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে পারত, তা হলে বুকটা একটু জুড়াত।
মুসার মনে হলো ওর ভাই ওকে হিংসে করছে। ও নিজে সার্কাস তারকা হতে পারলে খুশি হত যেন। এজন্যই এত খোঁচা মেরে কথা বলছে সে।
এ ছেলে যদি হিরো হতো তা হলে বরং ভালই হত। বাঁচা যেত। আর যা-ই হোক, সার্কাস তারকা হওয়ার কোনও খায়েশ নেই মুসার।
মুসার সাথে অমন করছ কেন তোমরা? মা ধমকে উঠলেন। এমনিতেই ও টেনশনে আছে। শেষ পর্যন্ত তোমাদের খোঁচাখুঁচিতে সব গুবলেট করে। ফেলবে হয়তো, দেখো।
একে একে সবার উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল মুসা। প্রত্যেকের পরনে উজ্জ্বল রঙের কস্টিউম দেখে ভাবল, পরিবারের সবাই সার্কাসের পাত্র পাত্রী নাকি?
ও আজ সার্কাস-পরিবারের সদস্য!
গলায় রুটি আটকে গেল। সার্কাস পছন্দ করে মুসা, কিন্তু আজ সার্কাসই ওর জীবন! ভাবতে ভাল লাগল না। ও এখন খুদে সার্কাস-তারকা!
ফাটা কপাল আর কাকে বলে!
রিহার্সালের সময় হয়ে এল! তাড়া লাগালেন বাবা। কালো একটা হ্যাট মাথায় চাপালেন। চলো সবাই!
পুরানো, লক্কর-ঝক্কর মার্কা একটা ভ্যানে চেপে বসল ওরা।
বাবা ড্রাইভিঙ সীটে। মা তাঁর পাশে।
পিছনে গাদাগাদি করে বসেছে মুসাসহ তাঁদের অন্য ছয় ছেলে-মেয়ে। ছয় বাঁদরের বাঁদরামি একমুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। এত দুষ্টু ছেলেমেয়ে
জীবনে দেখেনি মুসা। একটু পরপর পিচ্চি এক মেয়ে ওকে চিমটি কাটছে। আরেকটা অনবরত মুসার পেটে খোঁচা মারছে।
এক সময় বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল মুসা, অ্যাই, কী হচ্ছে! কেন বিরক্ত করছ?
কেন যে এত বাজে একটা পরিবারের সদস্য হতে গেল মুসা! এর চেয়ে কালকেরটা তো অনেক ভাল ছিল।
বেশ কিছুক্ষণ পর অনেক উঁচু, বিশাল এক তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়াল ভ্যান।
নামো সবাই! হুকুম দিলেন বাবা। নিজেও নেমে পড়লেন।
ভাইবোনদের অনুসরণ করে তাঁবুর ভিতরে চলে এল মুসা। ভিতরটা দারুণ পরিপাটি করে সাজানো। কয়েকজন সার্কাসম্যানকে প্র্যাকটিস করতে দেখা গেল। একেবারে তাঁবুর সিলিঙের কাছে টাঙানো একটা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা প্র্যাকটিস করছে এক লোক। নীচে নেট বিছানো আছে, পা ফসকে গেলে ওটার উপরেই পড়বে, হাত-পা ভাঙবে না। মাঝখানের গোল করে ঘেরা জায়গায় একটা হাতি পিছনের দুপায়ে খাড়া হয়ে আছে মাহুতের নির্দেশে। নাচের ভঙ্গি করছে। দুতিনজন ভড় দর্শক হাসানোর প্র্যাকটিস করছে।