বাধ্য হয়ে গেস্ট রুমের দিকে এগোল ও ক্লান্ত পায়ে।
ঘুমাতে যাচ্ছ? পিছন থেকে বলে উঠলেন মা। যাও, সোনা!
বিরক্তি লাগল মুসার। আমি কি কচি খোকা নাকি যে কথায় কথায় সোনা-সোনা করতে হবে?
সকালে তাড়াতাড়ি উঠো, কেমন? বলতে বলতে কিচেনের দিকে এগোলেন উনি।
সকাল!
একেকটা সকাল তো আগের দিনের সকালের তুলনায় অদ্ভুত চেহারা। নিয়ে হাজির হয় মুসার সামনে। অন্তত পরপর দুই সকাল তা-ই ঘটেছে।
কাল সকালে কী হবে কে জানে।
ঘুমিয়ে পড়তে ভয় করছে মুসার। অজানা ভয়ে অবশ হয়ে আসছে হাত পা। জেগে ওঠার পর নতুন কোনও অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না
আর কিছু না হোক, অন্তত একটা ব্যাপার ঘটলে খুশি হবে। সকালে উঠে যদি দেখে এই নকল মা-বাবা নেই হয়ে গেছেন, তা হলে ভীষণ খুশি হবে মুসা। কিন্তু ভাবল ও। আর এদের জায়গায় বড় কোনও আপদ এসে, জুটলে তখন?
হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখা যাবে পুরো পৃথিবীই বদলে গেছে। সূর্য উঠছে দক্ষিণ দিক থেকে।
তখন?
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। দুচোখ বুজে আসছে ঘুমে। চোখ খোলা রাখতে নিজের বিরুদ্ধে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে।
মনে মনে আল্লাকে ডাকল মুসা। বলল, আগের মত যেন সবকিছু স্বাভাবিক দেখতে পাই। বাবা-মা, ফারিহা, তানজিয়া আপু ও শাওনি ভাইকে যেন ফিরে পাই। খোদা, সবকিছু আবার স্বাভাবিক করে দাও তুমি। বাবা-মার অবাধ্য হব না কখনও। প্লিজ…
.
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না মুসা। চোখ মেলল একেবারে সকালে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠল না। কয়েক মুহূর্ত পড়ে রইল বালিশে মুখ গুঁজে। কিছু পরিবর্তন হয়েছে কি না বোঝার চেষ্টা করল।
ভিতর থেকে হইচই ভেসে আসছে। সারা বাড়ি যে তোক ভর্তি বুঝতে অসুবিধে হলো না কোনও।
অ-নে-ক মানুষ!
একটু একটু করে হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ছে মুসার।
সারাজীবন নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে এসেছে ও। তাই এ বাড়িতে হঠাৎ এত মানুষের সমাগম দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। কালকের বাবা-মা যে গায়েব হয়ে গেছেন, তাও কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছে।
সব চিন্তা মাথা থেকে ঠেলে সরিয়ে দিল মুসা। আগের চিন্তা আগে করা দরকার। প্রথমেই জানা দরকার আজ ওর বয়স কত।
উঠে বসে দুহাত চোখের সামনে মেলে ধরল।
নাহ্, ছোটই আছে। বয়স বাড়েনি, বরং মনে হচ্ছে যেন কমেছে।
তাড়াতাড়ি বাথরুমের দিকে এগোল মুসা। ভিতরের উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাল।
উত্তেজিত হয়ে কী লাভ? ভাবল ও। অমোঘ নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দেয়া ছাড়া কী করার আছে এই মুহূর্তে? যা ঘটছে সেটাই বাস্তব, এবং একে মেনে নেয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।
বাথরুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল মুসা। মনে হলো আজ যেন আয়নাটা একটু উপরে উঠে গেছে। ভাল করে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল।
পরক্ষণে চমকে উঠল–একি! এ যে একটা… একটা প্রায় শিশুর মুখ!
আর যাই হোক, ওর বয়স যে এখন তেরো নয়, তাতে কোনও সন্দেহই। রইল না ওর। খুব বেশি হলে আট বছর হবে আজকের মুসার বয়স।
এ কী আশ্চর্য!
আট! ভাবল ও তটস্থ হয়ে। আট বছর বয়সে ও কোন ক্লাসে ছিল মনে করার চেষ্টা করল। থ্রি! হ্যাঁ, থ্রির ছাত্র ছিল তখন মুসা।
তার মানে, মুসা আবার গ্রির ছাত্র বনে গেছে!
আচমকা পিঠে ব্যথা লেগে উঠল ওর। কেউ অথবা কিছু একটা পিঠে আঁচড় কাটছে বলে মনে হলো। আত্মা উড়ে গেল ওর।
ভিতর থেকে আপনাআপনি ঠেলে বেরিয়ে আসা চিৎকারটা। ঠেকানোর মরিয়া চেষ্টা চালাল। কিন্তু ব্যর্থ হলো শেষ পর্যন্ত।
বাড়ি কেঁপে উঠল ওর তারস্বরের চিৎকারে।
১৩
কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর পিঠের উপর।
চিকন, রোমশ মুখ দেখা গেল আয়নায়। অদ্ভুত একটা জন্তু বসে আছে কাঁধের উপর।
যা, ভাগ, যা! উদ্বাহু নৃত্য শুরু করে দিল মুসা।
মজা পেয়ে ইইইই! ইইইই! শব্দ করতে লাগল জটা।
প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দৌড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল মুসা। ছুটল করিডরের মাঝখান দিয়ে। ইয়া তাগড়া এক লোকের সাথে ধাক্কা খেল।
বাঁচান! মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। এটার হাত থেকে বাঁচান আমাকে!
ওর কাঁধের উপর থেকে জন্তুটাকে তুলে নিলেন মানুষটা। হাসতে হাসতে। ঢলে পড়ার দশা হলো তাঁর।
কী ব্যাপার, মুসা? কোনওমতে বললেন। ক্যাস্টেমকে এত ভয় পাওয়ার কী হলো? জন্তুটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন তিনি।
ক্যাস্টেম?
ওটা একটা বানর!
ওর চুল নেড়ে দিলেন ভদ্রলোক। বললেন, জলদি তৈরি হয়ে নাও। রিহার্সালের কথা ভুলে গেছ?
রিহার্সাল? কীসের রিহার্সাল?
আহাম্মকের মত তাঁর দিকে চেয়ে রইল মুসা। পেশিবহুল বিশাল দেহ। কোঁকড়া কালো চুল। মুখে ঘন দাড়ির জঙ্গল।
লোকটার পোশাক দেখে মুসার চোয়াল ঝুলে পড়ার দশা হলো। উজ্জ্বল লাল রঙের কস্টিউম পরে আছেন তিনি। সোনালি, একটা জমকাল বেল্ট কোমরের কাছে বাধা। যাত্রার নায়কের মত দেখাচ্ছে।
হায় আল্লা! মনে মনে আঁতকে উঠল ও। এই লোক কে? ওর আজকের বাবা নাকি? সর্বনাশ!
এ কীসের পাল্লায় পড়ল ও?
রান্নাঘর থেকে এক মহিলার কণ্ঠ ভেসে এল, ওগো, শুনছ?
ওর দিকে একই ধরনের এক সেট পোশাক এগিয়ে দিয়ে লোকটা বললেন, তাড়াতাড়ি এগুলো পরে নাও। তারপর খেতে এসো, জলদি।
মুসা জানে এই লোকটাই ওর বাবা। অন্তত আজকের জন্য। কাল সে ছিল এক পরিবারের সদস্য, আজ জুটেছে আরেক পরিবারের সঙ্গে।
অ্যাই! আবার সেই মহিলার গলা ভেসে এল। খেতে আসছ না কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো তোমার!