হাঁটছে তো হাঁটছে মুসা। কিছুক্ষণ পর সামনে একটা বাসা দেখতে পেয়ে। থেমে পড়ল।
আরে, এটাই তো ওদের বাসা! চিনতে পেরে এক দৌড়ে ঢুকে পড়ল মুসা। কিন্তু বাবা-মা বাসায় নেই। আঙিনা পার হয়ে দরজায় থামল ও। দরজায় তালা ঝুলছে।
ঘুরে ওদিকের বাগান পার হয়ে রান্নাঘরের সামনে থামল। ওখানে দরজার ছিটকিনিটা একটু নড়বড়ে। উপরের একটা ফাঁক দিয়ে চেষ্টা করলে খোলা যায়। তা-ই করল ও। কয়েক সেকেণ্ড চেষ্টা করতেই ছিটকিনি খুলে গেল।
ওর সত্যিকারের বাবা-মা গায়েব। ফারিহা, তানজিয়া, শাওনি ভাইও নেই।
কিন্তু এমন কেউ হয়তো থাকতে পারে, ভাবল মুসা, যে ওকে সাহায্য করতে পারে। উদ্ধার করতে পারে এই ম-হা-বি-প-দ থেকে।
হয়তো ওর বাবা-মা কোথাও বেড়াতে গেছেন ফারিহা, তানজিয়া ও শাওনি ভাইকে নিয়ে। কোনও আত্মীয়ের বাসায় গেছেন হয়তো।
একটা বুদ্ধি এল ওর মাথায়। মার এক খালাতো বোন থাকেন শহরের আরেক প্রান্তে। প্রায়ই ওখানে মা বেড়াতে যান। একবার টেলিফোন করে দেখবে ওঁকে, ঠিক করল ও। কপাল ভাল হলে বলা যায় না, ওখানে পেয়েও যেতে পারে মা-বাবাকে।
নির্দিষ্ট নাম্বারে ডায়াল করল ও। জবাবে মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল।
লিলি খালা! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল ও। আমি মুসা।
কে? গম্ভীর হয়ে উঠল কণ্ঠটা।
মুসা! রকি বিচ থেকে!
এ নামের কাউকে তো আমি চিনি না, ধীরে ধীরে বললেন মহিলা। মনে হয় ভূল নাম্বারে ফোন করেছ তুমি।
না, লিলি খালা, শুনুন!
আমার নাম লিলি নয়, ঘটাং করে রিসিভার রেখে দেয়ার শব্দ শোনা, গেল।
অনিশ্চিত চোখে টেলিফোন সেটের দিকে চেয়ে রইল মুসা। সঠিক নাম্বারে টেলিফোন করেছে ও, সে ব্যাপারে কোনও ভুল নেই। তবে কণ্ঠটা যে।
ওর লিলি খালার নয়, সেটা বুঝতেও কোনও ভুল হয়নি। তা হলে কে উনি?
তবু আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী? হয়তো রং নাম্বারে গিয়েছিল সেবার কলটা।
হ্যালো? একই কণ্ঠ ভেসে এল ওপাশ থেকে।
অন্যভাবে শুরু করল এবার মুসা। ফারিহা, তানজিয়া বা শাওনি ভাইকে একটু দেয়া যাবে? খুব জরুরী দরকার।
আবার তুমি! এখানে ওসব নামের কেউ থাকে না। রং নাম্বার।
পরমুহূর্তে লাইন কেটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল মুসা। প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে ও। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। যার বুকের মধ্যে ইস্পাতের হৃৎপিণ্ড আছে, সে-ও হয়তো এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। মুসা তো একে ছোট্ট, তার ওপর রক্তমাংসের মানুষ।
হাত-পা কাঁপছে ওর ঠঠ করে। ঘেমে গোসল হয়ে গেছে।
চট করে তিন গোয়েন্দাদের অন্য দুজনের কথা মনে পড়ল মুসার। প্রথমে ঠিক করেছিল ওদের কারও সাহায্য ছাড়া নিজের বিপদ নিজে মোকাবিলা করবে। কিন্তু সমস্যা আস্তে আস্তে এত জটিল হয়ে উঠেছে যে ওর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছে ওর একার পক্ষে সমাধান করার মত সমস্যা নয় এটা। অনেক বড়, অনেক কঠিন সমস্যা।
কিশোরদের নাম্বারে ডায়াল করল মুসা। কিন্তু আশ্চর্য! ফল হলো, সেই একই। কিশোর নামের কোনও ছেলে নাকি থাকে না ওই বাসায়।
আশ্চর্য! অদ্ভুত!
রবিনদের বাসায় রবিন নেই!
ওর দুই বন্ধু হাওয়া হয়ে গেছে।
মুসার চেনা পুরো পৃথিবীটাই যেন নেই হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ নতুন, অপরিচিত, আজব এক পৃথিবীর বাসিন্দা সে এখন।
এখানে সবাই ওর অপরিচিত, কাউকে চেনে না মুসা।
না, না, ঠিক হলো না।
একজনকে অন্তত চেনে, সে সানজানা।
কিন্তু ওর টেলিফোন নাম্বার তো মুসা জানে না! কীভাবে যোগাযোগ করবে? মেয়েটার পুরো নাম, বাসা কোথায় কিছুই জানে না। জিজ্ঞেস করতে মনে ছিল না।
এমন সময় সামনের দরজা খুলে গেল। সকালের সেই মহিলা, ওর মা। শপিং ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলেন।
ছেলেকে দেখে অবাক হলেন তিনি। কী ব্যাপার, মুসা! অসময়ে বাসায় কেন তুমি? স্কুল থেকে চলে এসেছ কেন?
আমি ওই স্কুলের ছাত্র নই, রাগের সাথে বলল ও। তাই।
তার মানে? খেপে উঠলেন মহিলা।
চুপ করে থাকল মুসা। ওর সমস্যা কী করে বোঝাবে ও এই মহিলাকে? ইনি তো ওর মা নন। আসল মা-ই বুঝতে চায় না…
পৃথিবী থেকে গায়েব হয়ে গেছেন ওর আসল মা। কী করে, কখন ব্যাপারটা ঘটল জানা নেই ওর। শুধু জানে, ও অন্য এক জগতে বিচরণ করছে।
অজানা এক শিহরণে কেঁপে উঠল মুসার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এমন এক পৃথিবী এটা, যেখানে ও একা। একদম একা। যেখানে কাউকে চেনে না। ও। এমন কী ওর বাবা-মাকে পর্যন্ত না।
১২
যাও, শরীর খারাপ লাগলে একটু শুয়ে থাকোগে, বললেন ওর মা।
সারা দুপুর-বিকেল টিভির সামনে বসে কাটাল মুসা। স্ক্রীনে চোখ স্থির থাকলেও মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তার ঝড় বয়ে গেছে।
মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত মুসা। কেন সে ওঁদেরকে নিজের মা-বাবা ভাবতে পারছে না? বাবা-মা হিসেবে ওদের যে তুলনা হয় না সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। তারপরও…
হয়তো এঁদের সঙ্গেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে ওকে। হয়তো আসল মা-বাবা ভাই-বোনকে কোনওদিন ফিরে পাবে না। তাই যদি হয়, তা হলে বাস্তবকে যত তাড়াতাড়ি মেনে নেয়া যায়, ততই মঙ্গল। তাতে মনের চাপ কমে যাবে। কোনও মতে রাতের খাওয়া সেরে উঠে পড়ল। নিজের রুমের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। দরজায় তালা ঝুলছে। দেখেই বোঝা যায় এই রুম ব্যবহার করা হয় না।
কী আর করা!