গেট পেরিয়ে স্কুল কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ল মুসা–এ ছাড়া আর কোথায়। যাবে? আর কী করার আছে? ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে স্কুল ভবনের দিকে। তাদের দেখাদেখি মুসাও এগোল। এই স্কুলের নিয়ম-কানুন কিছুই জানা নেই। এমন কী কোন্ ক্লাসে পড়ে ও, তাও না। সামনে এক মেয়েকে দেখল মুসাওরই বয়সী হবে।
হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে পেণ্ডুলামের মত দুলছে ওর বেণী, মাঝ পিঠ পর্যন্ত চুল মেয়েটার। কুচকুচে কালো।
কী মনে হতে ঘুরে তাকাল মেয়েটা। মিষ্টি করে হাসল ওর দিকে ফিরে।
ওকে চেনা চেনা লাগছে না? ভাবল মুসা। কোথায় যেন দেখেছে আগে।
কোথায়?
জবাবে মুসাও হাসল। নার্ভাস হাসি।
তোমার নাম কী? মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টার ফাঁকে বলল ও।
সানজানা।
সানজানা!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে এখন। কাল কলেজ থেকে পালানোর সময় এই মেয়ের সাথেই ধাক্কা খেয়েছিল ও।
আমার নাম মুসা, কাল তোমার সাথে দেখা… কথা শেষ না করে থেমে গেল।
মেয়েটা কি ওকে চিনতে পেরেছে? বুঝতে পারছে না মুসা। চেনার কথা নয় অবশ্য। কাল আর আজকের মুসার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সানজানার পক্ষে কি কল্পনা করা সম্ভব এই মুহূর্তে যে-ছেলেটার সাথে সে কথা বলছে, গতকাল তার বয়স বেশি ছিল? কলেজের ছাত্র ছিল সে?
ক্লাস শুরু হতে এখনও দেরি আছে, নীরবতা ভাঙল সানজানা। ওই গাছটার নীচে বসি গিয়ে, চলো।
চলো, যন্ত্রচালিতের মত ওকে অনুসরণ করল মুসা।
মেয়েটা যে খুব মিশুক, বুঝতে বাকি রইল না ওর। চমৎকার মিষ্টি ব্যবহার। জীবনটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়ার পর যতজনের সাথে দেখা হয়েছে মুসার, তাদের মধ্যে একেই ওর সবচেয়ে ভাল লেগেছে।
বড় একা লাগছে মুসার। অদ্ভুত ঘটনাগুলো কাউকে বলা দরকার, বুঝতে পারছে। এমন কাউকে, যে ওর সব কথা শুনবে, বিশ্বাস করবে এবং সমস্যাটা বুঝতে পারবে।
এই মেয়ে হয়তো বুঝবে, ভাবল মুসা। অন্তত ওকে দেখে সেরকমই মনে হয়। ভরসা করা যায়।
বসে পড়ল ওরা গাছের ছায়ায়।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল মুসা। সানজানা! ভাল করে দেখো তো আমাকে চেনা চেনা লাগছে কি না!
কপাল কুঁচকে তাকাল ও। কিছুক্ষণ দেখল মুসাকে।
হ্যাঁ, লাগে, বলল ও। তোমাকে নিশ্চয়ই স্কুলের আশপাশে কোথাও দেখেছি।
মেয়েটাকে সবকিছু খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিল মুসা। এসব আজগুবী কথা ও বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। তবু বলবে। কাউকে না কাউকে না বলা। পর্যন্ত স্বস্তি পাবে না ও। আমি তা বলছি না। বলতে চাইছি…
কী? বলো!
তুমি কাল রকি বিচ কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলে না?
হ্যাঁ। ওই কলেজের সামনে দিয়েই বাসায় ফিরি আমি।
গতকাল কারও সাথে তোমার ধাক্কা লেগেছিল? আমার চেয়ে বড়। এই ধরো মোলো-সতেরো বছর বয়স, এমন কারও সাথে? ঠিক কলেজের সামনে?
মুখ খুলতে যাচ্ছিল মেয়েটা, কিন্তু কিছু একটা চোখে পড়তে বন্ধ করে ফেলল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল মুসা।
দুই ছেলেকে এদিকে আসতে দেখা গেল। বয়সে তরুণ, তাগড়া গড়ন। একজন লম্বা, অন্যজন খাটো। কালো জিন্স ও কালো টি-শার্ট পরনে। একজনের মাথায় নীল স্কার্ফ বাধা। হাতের মজবুত পেশি দেখানোর জন্যই যেন হাতা গুটিয়ে রেখেছে অন্যজন।
কারা ওরা? দেখে ষোলো-সতেরোর মত বয়স মনে হয়। নিশ্চয়ই স্কুলের ছাত্র নয়। তা হলে এখানে কী করছে ওরা?
সোজা মুসাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের লাফালাফি নতুন উদ্যমে শুরু হয়ে গেছে মুসার। ছেলেদুটো যে বিপজ্জনক বুঝে ফেলল চট করে।
আগুন চোখে মুসাকেই দেখছে।
ও-ও-ওরা কারা? ভয়তাড়িত কণ্ঠে বলল মুসা।
জবাব দিল না সানজানা। সময় নেই।
হঠাৎ মুসাকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল এক ছেলে, ওই তো ব্যাটা!
সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার ছাড়ল অন্যজন, ধ ব্যাটাকে!
১১
পরমুহূর্তে একশো মাইল বেগে তেড়ে এল ওরা।
ওরা কারা, মুসা জানে না। এখন কিছু জানার সময়ও নেই। জান। বাঁচানো ফরজ। লাফ দিয়ে উঠেই দে ভোঁ দৌড়।
প্রাণপণে দৌড়ের ফাঁকে পিছন ফিরে তাকাল। সত্যি সত্যি তাড়া করেছে নাকি বদমাশ দুটো?
ধর ব্যাটাকে! তখনই আবার চেঁচিয়ে উঠল ওদের একজন।
ওদের বাধা দিল সানজানা। দাঁড় করিয়ে কী যেন বোঝাতে লাগল।
ধন্যবাদ, সানজানা, দৌড়ের ফাঁকে বিড়বিড় করে বলল মুসা। এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে স্কুলের সীমানার বাইরে চলে এল।
আরও খানিকটা গিয়ে যখন নিশ্চিত হলো ওরা আর তাড়া করছে না, তখন থামল। হাঁ করে হাঁপাতে লাগল।
সানজানা।
ওর জন্যই এ-যাত্রা বেঁচে গেল মুসা। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করা। নিরাপদ নয়। হাঁটতে লাগল আবার। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।
চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে। ঘরবাড়ি সব অপরিচিত। বাড়ির ফিরতি পথের দিকে হাঁটতে লাগল মুসা। বুঝতে পারছে, শয়তান দুটো যে-জন্যই হোক, ওকেই পিট্টি লাগাতে আসছিল, সানজানাকে নয়।
কিন্তু কেন?
কাল কলেজেও একটার পাল্লায় পড়েছিল মুসা। বাগে পেলে সত্যি যে মেরে ভর্তা করে দিত ওকে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আজ ওর নতুন, আজব পৃথিবীতে ওটা নেই অবশ্য, কিন্তু নতুন আপদ ঠিকই জুটেছে।
একটা নয়, দুটো!
নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে মুসার। কারও সাহায্য দরকার। মুসা জানে না এসব কী ঘটছে। এত সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষমতা নেই ওর। এত মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের থাকে?