মাথার উপরে চাবুক কষল ডাল-পালা। তবে বাতাস থেমে গেছে।
আমার চারপাশে ঘিরে দ্রুত উঠে আসছে কুয়াশা। ভারী, ঘন নিঃশব্দ।
পায়ের দিকে চোখ নামালাম। পা নয়, শিকড়ের দিকে। আতঙ্কে বুকের ভিতরে আর্তচিৎকার তৈরি হলো। আমি এখানে এসেছি মাটিতে শিকড় গাঁথতে, কে যেন মাথার ভিতরে বলল। কণ্ঠস্বরটা নিচু আর ভারী-এবং ভীতিকর।
গুঁড়ি ককিয়ে উঠল। গাছগুলো ঝুঁকে পড়ল আমার উপরে। ওদের নগ্ন ডাল ফিসফিস করছে, নড়ছে, মরা পাতা ঝরছে আমার চারপাশে।
এখানেই থাকো, কণ্ঠস্বরটা বলল আবারও। অন্য কণ্ঠগুলো গলা মেলাল-এখানেই থাকো।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাঁ হাতটা তুললাম। না! প্লিজ, যেতে দাও আমাকে! চিৎকার ছাড়তে চাইলাম। কিন্তু মুখ খোলে কার সাধ্য। শুধু ফুঁপিয়ে উঠলাম, কেঁদে ফেললাম, গাছটা যখন আমাকে গ্রাস করতে শুরু করল। মাথার উপরে উঠে গেল আঙুলগুলো। বেড়ে চলেছে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠতে চাইলাম। যতক্ষণ না কিছু একটা, ওগুলোকে টানা বন্ধ করল, বাড়তেই লাগল।
আমাদের সঙ্গে থাকো। শেষ শব্দটা ফিসফিস করে আমার চারধারে ঘুরতে লাগল। মাটি থেকে উঠে এসেছে কথাটা। আমার জায়গা এখন এখানে। কুঠারের ঘায়ে কাটা পড়েছে যে গাছটা আমাকে তার জায়গা নিতে হবে। শিউরে উঠলাম। ঝাঁকুনি খেল আমার ডাল-পালা।
আমার পিছনে ঝনঝন করে উঠল কিছু একটা। বহুদূর থেকে এল যেন শব্দটা। ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। অন্য কোথাও শুনেছি এই একই শব্দ।
বহু কষ্টে ঘুরে দাঁড়াতে পারলাম। পিঠটা কাঁচ-কোচ করে উঠল। ডান চোখে খুব সামান্যই দেখতে পাচ্ছি। শব্দটা জোরাল হতেই দেখতে পেলাম ওদেরকে। চারটে কিশোর এদিকেই আসছে। একজনের পরনে রুপোলী পেপাশাক। রবিন। মুসাকেও দেখতে পাচ্ছি।
আমার চারপাশ ঘিরে থাকা গাছগুলো নড়ে উঠল। খটখটিয়ে উঠল ডাল-পালা। কুঠার। ওদের চারজনের মধ্যে একজনের হাতে। কুঠার। খেপে উঠেছে গাছগুলো। আমি মাথা নোয়ালাম। ভয় পাচ্ছি ওদের উগ্র মেজাজকে।
একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল, দৌড়ে গিয়ে গাছগুলোকে ছুঁতে পারবে? আমার কুঠারটা দিয়ে হিট করে আবার দৌড়ে ফিরে আসবে!
গলাটা পরিচিত লাগল। রবিন? রবিন-মুসারা অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিবারের মত এখানে এসেছে। একে অন্যকে ভয় দেখাতে।
মনে পড়ে গেল আমি এখানে শিকড় নামাতে আসিনি। উপায় খুঁজতে এসেছি যাতে ব্যাপারটা এড়াতে পারি। ভয়, জেঁকে বসল বুকে। আমাকে পালাতে হবে। এখুনি সরে না পড়লে আর পারব না। কাঠের ভিতরে বন্দি হয়ে পড়েছি সত্যিকারের আমি।
মাথার উপরে, গাছগুলো আরও দীর্ঘ দেখাচ্ছে। বিনা বাতাসে দোল খাচ্ছে ওরা। ফট করে উঠল একটা ডাল। পিছনে হেলে মুখ। তুলে চাইলাম। আমার পাশের গাছটার একটা ডাল আলগা হয়ে ঝুলছে। পড়ে যাবে যেন যে কোন মুহূর্তে। আলো পড়তেই সরে গেল বাকল, মুখটা দেখতে পেলাম। ওরা ঠিক এভাবেই আটক করেছে আমাকে। নিজেদের একটা করে ডাল ফেলে দিয়েছিল আধ-মরা গাছটার উপর, কাটা হয়েছিল যেটাকে। এবার ওরা রবিন, মুসা আর অন্যদের পিছনে লেগেছে।
না! মাথার মধ্যে শব্দটা তৈরি হলো, কিন্তু আমার তো মুখ নেই যে প্রকাশ করব।
টিনের কাঠুরের পোশাক পরা রবিন আরও কাছিয়ে এল।
ঠিক আছে, আমি করে দেখাচ্ছি তোমাদেরকে।
রীতিমত কসরৎ করে পা দুটো তোলার চেষ্টা করলাম। ওকে সতর্ক করতে হবে। ওদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াব এখান থেকে। ওরা আহত হওয়ার আগেই। ওরা কামড় খেয়ে আমার মত কাঠের বাকলে মুড়ে যাওয়ার আগেই কাজটা করতে হবে।
অতিকষ্টে ডান পা তুলতে পারলাম, ফলে ঘুরে দাঁড়ানো গেল।
রবিন থমকে দাঁড়াল। মুখটা হাঁ। ওর মুখের চেহারা দেখে বুঝলাম ও টের পায়নি ওটা আমি। সশব্দে ডান হাতটা নীচে নামিয়ে গেটের দিকে ইঙ্গিত করলাম।
চলে যাও! কথাগুলো বলতে চেয়েও পারলাম না। তার বদলে ককিয়ে উঠল আমার ডালগুলো। বুকের গভীর থেকে উঠে এল হাহাকার।
রবিনের মুখের চেহারা ছাই বর্ণ। নকল কুঠারটা ফেলে দিয়ে ঘুরেই দৌড় দিল।
ওর বুকের টিনটা ঠং-ঠং করে উঠল। মুসা আর অন্যান্যরাও আর্তনাদ ছেড়ে ওর পিছু নিল। আমার পিছনে মুখওয়ালা ডালটা ফটাস করে ভেঙে পড়ল। রবিন কুঠারটা যেখানে ফেলে গেছে ঠিক তার উপরে। মুখটা বেঁকে গিয়ে কামড় বসাল কুঠারটায়।
ঘুরে দাঁড়ালাম। দেহ আড়ষ্ট। এতটাই ক্লান্তি বোধ করছি, নড়ার সাধ্য নেই। ওরা জিতে গেছে। আমি মারা যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে। একমাত্র চোখটা বুজে ফেললাম।
দুনিয়াটা পাল্টে গেছে। বাতাস, মাটি আর আকাশটা অনুভব করছি আমি। অন্যান্য গাছগুলো ঝুঁকে পড়েছে আমার উপরে। ডালগুলো অশুভ ভঙ্গিতে নিচু হয়ে দোল খাচ্ছে আমার উদ্দেশে।
আমি থাকব এখানে, যদি থাকতেই হয়। আমি এখানে অন্য কারও জায়গা নেব। কিন্তু অন্যদেরকে তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদের কোন ক্ষতি তোমরা করতে পারবে না-গাছগুলোকে মনে মনে বললাম।
আমার ছড়ানো আঙুলের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। গাছগুলো আমার কথা শুনতে পাচ্ছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। ওদের মরা পাতা ফিসফিস করছে আমার সঙ্গে। মাথার ভিতরে ওদের কণ্ঠস্বর-হারানো বন্ধু সম্পর্কে কথা বলছে ওরা।
আমার পায়ের পাতা থেকে মাটির গভীরে দেবে যাচ্ছে শিকড়। বুকের বাকল শক্ত হচ্ছে ক্রমেই। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গেছে, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে হলদে রস।