রীড? ডাকলাম। শব্দটা আড়ষ্ট শোনাল।
কাজ থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকাল লোকটা। একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে, আপাদমস্তক জরিপ করে নিল। এবার এক পা এগিয়ে এল।
চমৎকার কস্টিউম পরেছ।
ত্যাগ করলাম।
ধন্যবাদ।
একটা দস্তানা খুলে আমার মুখে হাত বুলাল ও। কোন অনুভূতি হলো না আমার।
দারুণ। আসল বাকল। গাছ থেকে খুলতে নিশ্চয়ই কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছে। গাছটাকে মেরে ফেলনি তো?
না, জানালাম।
স্কুলে লেখা নোটটা বের করে ওর হাতে দিলাম। চাচার স্টাডি। থেকে জোগাড় করা বিলটাও দিলাম।
নোট আর বিলটা এক পলক দেখে নিয়ে আমার দিকে চাইল ও।
এমন অদ্ভুত কথা আমি আগে কখনও শুনিনি। এই কাঠগুলোর জন্যে এত চিন্তা করছ কেন?
নোটটার দিকে আঙুল তাক করলাম।
আরও খানিকদূর পড়ে মাথা নাড়ল ও।
ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট? রিপোর্ট করবে? মাথা ঝাঁকাল, ও। আমরা আমাদের সময় বুক রিপোর্ট করতাম। তুমি জানতে চাইছ তোমাদের কেনা কাঠ কোথা থেকে এসেছে? এবং এর মধ্যে স্পেশাল কোন ব্যাপার আছে কিনা। বিলটা দেখে নিয়ে মাথায় হাত বুলাল ও। গত সপ্তাহে কাটা হয়েছে। নিশ্চয়ই বুড়ো অ্যাশ হবে।
আমার বাহুর দিকে চাইল আবারও।
বুঝেছি। অ্যাশের বাকল কোত্থেকে পেয়েছ বুঝতে পারছি। ওই গুঁড়িগুলো থেকে। গাছও ছিল বটে একখান। আশি ফুট লম্বা। ওরেগন অ্যাশ। ল্যাটিফোলিয়া বলা হয়। শীতে গান ঋরে। গাছটা কাটার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কী করব-আধমর ছিল, পরের ঝড়টা এলেই পড়ে যেত।
কথা বলেই চলল ও, বেশির ভাগই আমার জন্য অপ্রয়োজনীয়। শেষমেশ জিজ্ঞেস করতে পারলাম, কোথায়?
কথাটা জড়িয়ে গেল। আমার দিকে চেয়ে রইল ও।
ও, আচ্ছা, জিজ্ঞেস করছ ওটা কোথায়? তুমি হয়তো চেনো জায়গাটাকে। মাথায় হাত বুলাল আবারও। পার্ক স্ট্রীটের পুরানো কবরগুলোয় যে অ্যাশ গাছগুলো আছে ওটা তারই একটা।
৬
গোরস্থানে যখন পৌঁছলাম, সূর্যটা তখন অগ্নিগোলার মত ফেটে পড়তে চাইছে। আকাশের বাদবাকি অংশ ঢাকা পড়েছে ছায়ার আড়ালে। লনেও বিস্তৃত হয়েছে ছায়া-শুকনো বাদামী পাতার অনেকখানি অবধি গ্রাস করেছে।
রীড আমাকে আর কিছু বলেনি। গাছ-পালা নিয়ে অনেক কথা বলেছে। আমার প্রশ্নগুলোয় চোখ বুলিয়েছে। কারও চামড়া বাকলের মত হয়ে গিয়েছে কিনা-প্রশ্নটা পড়ে হেসেছে।
পার্ক স্ট্রীট শহরের পুরানো এলাকায় পড়েছে। কবরস্থানের অন্ধ গলি ওটা।
এ শহরের অন্যপ্রান্তে নতুন এক কবরস্থান বানানো হয়েছে। সেটা পার্ক স্ট্রীটের মত ভুতুড়ে না। পার্ক স্ট্রীটটা গা ছমছমে বলেই আমরা সব সময় এখানে আমাদের হ্যালোউইন শেষ করি।
ভূতের গল্প বলি আমরা। ক্লাসের নতুন ছেলে কিংবা মেয়েটিকে কবরগুলোর মাঝখান দিয়ে দৌড়তে বলি।
রবিন আর মুসা আজকে এখানে আসবে কিনা কে জানে।
এক কিনারে এক সার গাছ। লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা বাদবাকি অংশ।
কবরগুলোর দিকে চাইলাম। মার্কারগুলোকে পাত্তা দিলাম না। কিন্তু অস্তরাগের, পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা, প্রাচীন গাছগুলোকে পছন্দ হলো না আমার।
মরচে ধরা লোহার গেট দিয়ে ঢুকে, গাছ-গাছালির উদ্দেশে পা চালালাম। দানবের মত দাঁড়িয়ে ওরা। আশি ফুট লম্বা, নার্সারির লোকটা বলেছিল। আশপাশের বাড়ি-ঘরের চাইতেও লম্বা। কবে থেকে ওগুলো এখানে আছে কে জানে।
পা ব্যথা করছে। জুতো খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে, তবে অতটা ঝুঁকতে পারব কিনা জানি না। এসময় শব্দটা কানে এল। ১. চোখ নামিয়ে চাইলাম। শেষ বিকেলের আলোয় পায়ের কাছে। কিলবিলিয়ে উঠল গাছের শিকড়। এবার ঘুরে গিয়ে ঢুকে পড়ল মাটির গভীরে। ঝটকা মেরে পা সরালাম। লাফিয়ে সরে আসতেই এক গোছা ঘাস উঠে এল।
বসে পড়ে, পা তুলে মাটি থেকে শিকড়টা টেনে বের করতে চেষ্টা করলাম। প্রান্তগুলো, তখন কিলবিল করছে। থাবড়া মারলাম। মনে প্রাণে চাইছি এ অবস্থা থেকে যাতে মুক্তি পাই। শেষমেশ আমার স্নিকার্স পেঁচিয়ে ধরল শিকড়গুলো। চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। ভাল চোখটা বন্ধ করলাম। আমি আগের মত হতে চাই। মনে হলো বুকের উপর চেপে বসেছে জিনিসটা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কী হবে?
উঠে দাঁড়িয়ে লন ধরে আবারও পা বাড়ালাম। যদূর সম্ভব মেটো পথ ধরে চলেছি। দ্রুত হাঁটছি। পায়ের দিকে চাইছি না, কিন্তু গজিয়ে ওঠা কিলবিলানো শিকড়গুলোকে অনুভব করতে পারছি।
ডান পা আর বাহুতে ছড়িয়ে পড়েছে চুলকানি। বুকের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে। পেটও। শরীরের বা পাশটা পুরোপুরি অবশ।
আমার সামনে সারিবদ্ধ সৈন্যের মত দাঁড়িয়ে এক সার গাছ।
মাঝখানে ফাঁকা একটু জায়গা। ওখানে, সমতল এক গুঁড়ির অংশবিশেষ।
কাছিয়ে গেলাম। মাটিতে ছায়া ফেলেছে গাছগুলো। বিষণ্ণ পরিবেশ। কুয়াশা উঠছে মাটি থেকে।
পশ্চিমা বাতাস বইছে। থমকে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চাইলাম। সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে চাঁদ নেই। একটা তারাও চোখে পড়ল না। কী করছি এখানে নিজেও জানি না। মনে পড়ছে না। কী করতে এসেছিলাম?
ভুলে গেছি। কী যেন খুঁজতে এসেছিলাম এখানে, তাই না?
গাছগুলো মৃদু মর্মরধ্বনি করছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিতে চাইলাম, কিন্তু শিকড় গেঁথে গেছে মাটিতে। পা তুলতে পারছি না। কান্নার মত ককিয়ে উঠে বাঁ পা চেপে ধরে টান দিলাম।
গাছের রুক্ষ বাকল যেন মোলায়েম হয়ে বদলে গেছে। মুখ উদয় হয়েছে। মানুষের মুখ নয়। প্রাচীন মুখ। ঘৃণায় বিকৃত। পটাপট খুলছে চোখ। মাটিতে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হলো আমার। শূন্য কোটর। শুধু নিখাদ অন্ধকার।