পা টেনে টেনে কিচেনের পাশে এলাম।
চাচী আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই তার মুখের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রেযর ব্লেডের স্টান্টের সময় তার কাছ থেকে এই বিস্ময় আশা করেছিলাম আমি। এখন নয়, কেননা এবারেরটা তো সত্যি।
কিছু বললাম না। বলার চেষ্টাও করলাম না। মুখের ভিতরটায় চুলকানি আর জ্বালা-পোড়া শুরু হয়েছে। মুখের ভিতরে পিঁপড়ে যেন পিলপিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এবারের ফার্স্ট ইযটা তুই-ই পাবি, বলল চাচা। কিচেনে এসে ঢুকেছে। যদি বলিস তো তোকে আজকে নিয়ে আসতে পারি।
মাথা নাড়লাম। একটা পরিকল্পনা এসেছে মাথায়।
রবিনের বাসায় যাব স্কুলের পরে, বললাম। কণ্ঠস্বরটা নিচু আর ভারী শোনাল। গলায় একটা হাত রাখলাম। মুখের ভিতরটা শুকনো ঠেকছে। মুখের অর্ধেকটা ঢেকে দিয়েছে বাকল।
চাচী আমার দিকে চাইল।
কিশোর, এই পোশাকে খেতে পারবি তো?
খিদে নেই। কেমন জানি জড়িয়ে গেল কথাগুলো।
কমলার রসে ঐ রাখল চাচী।
তা হলে অন্তত এটা খেয়ে যা।
তেষ্টা পেয়েছিল। পান করলাম। বিস্বাদ লাগল। বাইরে তাকাব না পণ করেছি। মাটির টান অনুভব করছি দস্তুর মত-গতকাল কী ভালই না লেগেছিল মাটির স্বাদ।
গাড়ি করে স্কুলে যাওয়ার পথে চাচা কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কীভাবে পোশাকটা বানিয়েছি। জড়ানো, অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দেওয়ার। পর চাচা বলল, এ নিয়ে পরে কথা বলবে।
সে সময় পেলে হয়, বললাম মনে মনে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করেছে।
বাইরে কুয়াশা, আঁধার-স্যাঁতসেঁতে ভাব। চাচার পরনে মোটা সোয়েটার। অথচ সাধারণ শার্ট আর জিন্সেই ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি। আমি।
গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।
এই পোশাকে ঠিকমত নড়াচড়া করতে পারবি তো? চাচার প্রশ্ন।
ঝুঁকে পড়ে জানালার কাঁচ ভেদ করে চাইলাম। হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মুখের বা পাশটা নড়ল না। অস্পষ্ট জবাব দিয়ে চাচার দিকে চেয়ে রইলাম। অদ্ভুত এক ভুতুড়ে অনুভূতি-এবারই হয়তো শেষ দেখা-তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে বাধ্য করল। এবার মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা।
স্কুলে গোটা দুই ভ্যাম্পায়ার আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। দুটো গোলাপি ভূত চেয়ে রইল আমার দিকে, আমি এখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠন পেরোচ্ছি। বাঁ পা চুলকাতে শুরু করেছে। দাপাতে ইচ্ছে করছে, এতটাই চুলকাচ্ছে আর জ্বালা-পোড়া করছে। কিন্তু হাটু ভাঁজ করতে পারলাম না।
অ্যাই, কিশোর!
ঘুরে দাঁড়াতে রবিনকে দেখতে পেলাম। বুকের উপর রুপোলী এক ট্র্যাশ ক্যান পরেছে ও। মুখের রং রুপোলী। হাতে কুঠার। ধারাল ফলা দেখে সরে দাঁড়ালাম একপাশে।
আমি টিনের কাঠুরে! কুঠার দুলিয়ে বলে উঠল ও। লক্ষ করলাম কুঠারটা রবারের। স্বস্তির শ্বাস ছাড়লাম। দাঁত বের করে হাসল রবিন। আজকে রাতে সবাইকে ভড়কে দেব!
আরও কয়েকটা ছেলে-মেয়ে ঘিরে ধরল আমাকে। ওদের একজন হাত বাড়িয়ে আমার বাহু স্পর্শ করল।
আমি কাউকে ভয় দেখাতে চাই না, আওড়ালাম। অবাক চোখে। সবাই চেয়ে রইল আমার দিকে। রবিন হাসল আবারও।
তুমি তো এর মধ্যেই সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ, বলল।
মেজাজটা সহসাই বিগড়ে গেল। এরা মনে করছে আমি হ্যালোউইনের পোশাক পরেছি। এদেরকে এমন ভয় দেখাব যাতে চিরদিন মনে থাকে। ওদেরকে ভয় দেখিয়ে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ব। ওদের বুঝিয়ে দেব এমন ঘটনা ওদের জীবনেও ঘটতে পারে।
মুখের কাছে হাত এনে নাকের বাকল টেনে তুললাম। দুটো মেয়ে আর্তনাদ ছাড়ল। আরও দুজন ছেলে পিছু হটল। মুখে হাত ঘষে মাখিয়ে নিলাম হলদে রস। এবার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ওদের উদ্দেশে।
তোমাদেরকে আমার মত করে দেব! চেঁচিয়ে উঠলাম।
মেয়ে দুটো ঘুরেই দিল দৌড়। বেল বাজলে সবাই ক্লাসের উদ্দেশে ছুটল। আমি বাহুটা নামিয়ে ফেললাম।
দুর্দান্ত! বলে রবিন ঠং-ঠুং শব্দ তুলে হেঁটে এল আমার কাছে।
তোমারটাই সেরা। সবাই যা ভয় পাবে না! আমার দিকে চেয়ে। চওড়া হাসল। একবার শুধু চামড়া তুললেই হলো।
ডান কাঁধ ঝুলে পড়ল আমার।
এসব দেখাব কখন? আমার আরও কাজ আছে।
ভ্রূ কুঁচকে চাইল নথি।
বলো কী? নতুনদেরকে ভয় দেখাতে হবে না?
আচ্ছা, মুসা কোথায়? শ্রাগ করে জিজ্ঞেস করলাম।
দেখছি না তো। হয়তোঁ আছে কোথাও, জানাল রবিন।
ক্লাসের দিকে পা বাড়ালাম আমরা।
স্কুল আগে আগে ছুটি দিলেও আমার মনে হচ্ছিল সময় যেন আজ আর ফুরোচ্ছেই না। সেরা কস্টিউম আমারটাই হলো। মিসেস হকিন্স আমার ডান হাতে রিবন বেঁধে দেওয়ার সময় অদ্ভুত চোখে চাইলেন। স্কুল থেকে বেরিয়েই রিবনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
রবিনের মাকে অনুরোধ করলাম আমাকে নার্সারিতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ওঁকে বললাম চাচার সঙ্গে ওখানে দেখা হবে আমার। রবিন আমার উপর অভিমান করে রয়েছে। কথা বলল না। গাড়ি থেকে নেমে ওদেরকে চলে যেতে দেখলাম।
কাউন্টারের পিছনে বসা মহিলা আমার দিকে চেয়ে হাসল। প্রশংসা করল আমার কস্টিউমের। অতিকষ্টে জিজ্ঞেস করতে পারলাম কে বেচেছিল কাঠগুলো। মহিলা এমনভাবে হাসল যেন কৌতুক করেছি আমি।
রীড তোমাকে হেল্প করতে পারবে। ও পিছনে আছে।
পিছনে চলে এলাম। মাটিতে গাঁথা গাছগুলোকে দেখে জিভে জল এল আমার।
সোনালীচুলো এক যুবক কাঠ গাদা করছিল। কাঠগুলোর দিকে চাউনি বুলালাম। কোন চোখ-মুখ নেই, কাজেই কাছিয়ে গেলাম।