কাঠের স্তূপের কাছে পৌঁছলাম। গুঁড়িগুলোকে মানুষের মুখের চেহারার মতন লাগছে। একটা গুঁড়িতে লাথি মারতেই গড়িয়ে গেল। আমি ওদের মুখ দেখতে চাই না।
এসব বন্ধ করো! চেঁচিয়ে উঠলাম। ভীত। ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম। দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছি কুঠারটা। এবার এক কাঁধের উপর তুলে সজোরে নামিয়ে আনলাম। কোন্ গুঁড়িটায় আঘাত হানলাম জানতে চাই না আমি। শুধু চাই ওদের মৃত্যু। মুক্তি চাই ওদের হাত থেকে চিরদিনের জন্য।
কুঠারটা গেঁথে গেল কাঠে, দেবে গেল বাকলের ভিতরে।
পরমুহূর্তে, অসহ্য যন্ত্রণা করে উঠল আমার বাঁ বাহুটায়।
৫
বহু চেপে ধরলাম। কুঠার ফেলে দিয়ে পড়ে গেলাম হাঁটুর উপরে। তীব্র ব্যথা। মিনিটখানেক মাটিতে পড়ে রইলাম নিথর। তারপর কোনমতে উঠে দাঁড়াতে পারলাম। পিছনের দরজার কাছে গিয়ে বাড়ির গায়ে হেলান দিলাম।
হলদে রস বেরিয়ে আসছে বাহুর এক দাগ থেকে। সদ্য জন্মানো দাগটা দেখে মনে হচ্ছে কুঠারের কাটা বুঝি। হাত চাপা দিয়ে ব্যথা কমাতে চেষ্টা করলাম। বাহু থেকে পিঠ অবধি ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র যন্ত্রণা।
মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছি, হেলান দিলাম পিছনে। চাচী যদি আজকে আগুন জ্বালতে চাইত তা হলে কী হত? গুঁড়ি পোড়াতে যদি চাইত? অসুস্থ বোধ করলাম। কাঠ পোড়ালে হয়তো আমার গায়েও আগুন ধরে যেত।
আজ রাতে আগুন জ্বালতে দেওয়া যাবে না। আমার সঙ্গে যা ঘটল তার পর তো প্রশ্নই ওঠে না।
ভিতরে গেলাম আমি।
চাচা-চাচী লিভিংরূমে। তাদের নিচু গলার কথা-বার্তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কাছিয়ে গেলাম যাতে শুনতে পারি।
কিশোর বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে না তো? চাচীর কণ্ঠ ক্লান্ত আর উদ্বিগ্ন শোনাল।
উঁকি মেরে দেখি সোফায় বসে চাচী। তার পাশে চাচা।
মজা করছে করতে দাও। আমিও প্রথম প্রথম করেছি। শীঘ্রি থেমে যাবে, চাচা জবাবে বলল।
চাচার বাহুতে হাত রাখল চাচী।
তোমাদের দুজনের মধ্যে কার স্টান্ট যে বেশি ভয়ঙ্কর বুঝি না, বাবা!
মৃদু হাসল চাচা।
কে জানে, এই গুণ কাজে লাগিয়ে ও একদিন হয়তো অনেক বড় হবে।
চাচীর মুখেও স্মিত হাসি ফুটল।
হ্যালোউইন পর্যন্ত কিছু বলব না আমি। তারপর কিন্তু এসব বন্ধ করতে হবে। এই প্রথম ওর কস্টিউম দেখে ভয় পেয়েছি আমি। আমি এসব আর দেখতে চাই না।
চাচী আর চাচার গলা খাদে নেমে গেল। সরে এলাম আমি। অন্ধকার হল-এ এসে বাহুর দিকে চাইলাম। আমিও এসব আর দেখতে চাই না। কিন্তু কীভাবে মুক্তি পাব এটার হাত থেকে? হাসপাতালেও কি এর চিকিৎসা আছে? মনে তো হয় না।
বাকল এখন আমার বুকে ছড়িয়েছে। চামড়া বেয়ে গুঁড়ি মেরে পায়ের দিকে চলেছে। আর কদিন সময় আছে আমার হাতে? একদিন? হয়তো। কিন্তু হ্যালোউইনের পরে কতখানি বাকি থাকবে আমার? আসল আমার কথা ভাবছি।
কিছু একটা করতে হবে, এবং দ্রুত। কাঠগুলো কোত্থেকে এসেছে জানতে পারলে হয়তো কোন সমাধান পেতে পারি। জঙ্গল। সম্পর্কে জানে এমন কেউ হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারবে।
হল ধরে এগিয়ে চাচার স্টাডিতে ঢুকলাম।
স্টিলের বাক্সে মেকাপের সরঞ্জাম রাখে চাচা। সার বেঁধে ওগুলো রাখা হয়েছে তার ডেস্কের পাশে। একগাদা কাগজ ছেয়ে রেখেছে। ডেস্ক, ফোন আর অন্যান্য সব কিছু।
ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়ে কাগজগুলোয় চোখ বুলালাম। বেশির ভাগই বিলের মতন দেখাল। কয়েকটা হলদে পোস্ট-ইট নোটে হিজিবিজি করে লেখা: মো লন। শেষমেশ খুঁজে পেলাম।
গোলাপি এক স্লিপে লেবেল সাঁটা: শেরিংহ্যাম নার্সারি, কাঠের অর্ডার দেয়া হয়েছিল এখানে। বিলটা ভাঁজ করে পকেটে রাখলাম। কাল স্কুলের পর ওখানে গিয়ে খোঁজ-খবর নেব।
ডিনারে, চাচা-চাচী এমন সহজ আচরণ করল, আমার বাহু নিয়ে যেন কোন সমস্যা নেই। ডিনারের পর সিঙ্কে প্লেট নিয়ে গেলাম। চাচী আমার চুল এলোমেলো করে দিল।
আজ রাতে আগুন জ্বাললে কেমন হয়? কয়েকটা মার্শম্যালো, কিছু চকোলেট আর গ্রাহাম ক্র্যাকার রয়ে গেছে, বলল।
চাচী, ভয়ানক গরম লাগছে।
আমার দিকে চাইল চাচী।
কোথায় গরম?
তুমি আগুন জ্বাললে আমি পুড়ে যাব। ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করলেও গলা ধরে এল। কথাটা তো আক্ষরিক অর্থেই সত্যি।
চাচী চাচার দিকে এক ঝলক চাইল।
ঠিক আছে…
আজ রাতে না, বলে উঠলাম আমি। হাসার চেষ্টা করলাম।
আগুন জ্বাললে আমার আঠা গলে যাবে।
এবার হাসি ফুটল চাচীর মুখে।
বুঝেছি। ঠিক আছে, আমরা না হয় আরও দুএকদিন আগুন জ্বালব না।
খানিক পরে নিজের ঘরে চলে এলাম।
বাহুতে আর কোন অনুভূতি নেই। ঘাড় আর মুখে চুলকানি, জ্বালা-পোড়া। কালকে আমাকে কেমন দেখাবে তা নিয়ে ভাবতে চাই না। শুধু কামনা করছি নার্সারিতে পৌঁছবার আগে পর্যাপ্ত সময় পাব।
ঘুম ভাঙতে, মুখে হাত বুলিয়ে ছুটে গেলাম।
বা চোখ ঢাকা পড়েছে বাকলের নীচে। পাজামা টপ খুললাম। বুকেও ছড়িয়েছে জিনিসটা। বাঁ পা-টা কেঠো, আড়ষ্ট ঠেকছে। বাঁ হাতের দিকে চাইলাম।
আঙুলগুলো লম্বা হয়ে গেছে। ডাল-পালার মত বাঁকা। এমনকী বাঁকাতেও পারছি না। ডান বাহুতে এমন জ্বলুনি শুরু হয়েছে। হাতে সময় বেশি নেই।
কাপড় পরতে অনেক সময় লেগে গেল। ঢোলা জিন্স পরতে হলো। শার্টের হাতায় বাঁ হাত ঢোকাতেই কাঁচ-কোচ শব্দ হলো। তুলে ধরে রাখতে ভাল লাগল।
এবার দেখতে পেলাম উঁচিয়ে রাখলে গাছের ডালের মত দেখায়। ডান হাতে বাঁ হাতের কব্জি চেপে ধরে বাহুটাকে নীচে নামিয়ে আনলাম। নামতে চাইছিল না, টেনে নামাতে হয়েছে। সামনে কঠিন সময়।