এক মুঠো ধুলোমাটি ছেড়ে দিলাম আঙুলের ফাঁক দিয়ে। কালো মাটির দলা পড়ল মাঠে। এক দলা মাটি আটকে গেল আমার দু আঙুলের ফাঁকে। মুখে আঙুল পুরে মাটি চাটলাম।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক মুঠো মাটি চালান হয়ে গেছে, আমার মুখের ভিতরে। ঝুঁকে পড়ে থু-থু করে ফেলে দিলাম। মুখ মুছে নিলাম। তবে তাতে কোন লাভ হলো না। মাটির স্বাদ ভাল লেগেছে আমার।
যে দ্রুত গতিতে রূপান্তর ঘটছে আমার, হ্যালোউইনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
৪
স্কুল কেমন হলো? কাগজ থেকে চোখ তুলে প্রশ্ন করল রাশেদ চাচা। কিচেনে ঢুকেছি আমি।
চাচাকে বাহু দেখাতে ইচ্ছে করছে না। যদি বিশ্বাস না করে? কিন্তু করতে হবে। স্টান্ট দেখিয়ে চাচাকে ধোকা দেওয়া সম্ভব নয়। চাচা নিশ্চয়ই বুঝবে আমারটা আসল।
সোয়েটশার্টের হাতা তুলে বাহু বের করলাম।
চাচা, দেখো।
চাচা এক ঝলক চাইল বাহুর দিকে, তারপর মৃদু হেসে শিস দিয়ে উঠল। কাগজটা নামিয়ে রেখে আমাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল।
কী এটা?
আমার বাহুটাকে এমুহূর্তে কাঠের গুঁড়ির মতন দেখাচ্ছে। বাকলটা আরও শক্ত হয়েছে। আঙুলের তলা দিয়ে বেরনো শিকড়গুলো আরও জড়িয়ে-পেঁচিয়ে গেছে। এখন আর টান দিয়ে বাকল তোলা সম্ভব হচ্ছে না, শুধু কিনারাগুলো ছাড়া। বাকল ছড়িয়ে পড়েছে ঘাড় থেকে পিঠ অবধি। চিড়চিড় করে জ্বলছে। পিঠ চুলকোতে গেলে বাহুতে ব্যথা লাগছে।
আঙুলের গাঁট দিয়ে আমার বাঁ বাহুতে টোকা দিল চাচা। ঐ কুঁচকে গেছে।
ব্যাপারটা সিরিয়াস।
মাথা ঝাঁকালাম। চোখভরে পানি আসছে। কাঁদতে চাই না। চাই চাচা একটা কিছু করুক।
গুঁড়িটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে, চাচা। আমাকে বদলে দিচ্ছে।
আমার দিকে ভ্রূ তুলে চাইল চাচা।
আধা মানুষ আধা গাছ, এভাবেই রাখবি? নাকি পুরোটাই করবি?
চাচা! এটা সত্যিকারের কাঠ। বাহু তুলে ধরলাম। আঙুলগুলো নাড়তে গেলে শব্দ করে উঠল। একটা আঙুলও ঠিকমত নড়ল না।
নিশ্চয়ই। আইডিয়াটা ভাল। সত্যিকারের কাঠ লাগিয়ে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছিস। সারাদিন ধরে আঠা দিয়ে এক টুকরো এক টুকরো করে লাগিয়েছিস, তাই না? কোন্ আঠা ব্যবহার করছিস তুই? আমার ঘাড়ের কাছের বাকল খুঁটল চাচা। তারপর নাক কুঁচকে সরে গেল। এহ, পচা গন্ধ। তোর চাচী খুব খেপাবে।
অতি কষ্টে নিজেকে সামলালাম। চাচাকে বিশ্বাস করাতে হবে আমার কথা।
এটা আঠা নয়, চাচা, রস। জিনিসটা আমাকে গাছ করে দিচ্ছে!
আমার কাঁধে হাত রাখল চাচা। তার দিকে চাইলাম। মাথা। ঝকাল চাচা, মুখের চেহারা গম্ভীর।
আমি কাউকে বলব না এটা বানোয়াট। আমি তোর কাজ দেখে গর্ব বোধ করছি।
চাচা, আমার ডাক্তার দেখানো দরকার! উদ্গত অঞ চেপে বললাম।
তা হলে তো গাছের ডাক্তার ডাকতে হয়। বলে আমার উদ্দেশে। চোখ টিপে আবার কাগজ নিয়ে বসল চাচা।
পা টেনে টেনে নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা লাগিয়ে দিলাম। সজোরে। বিছানায় গা ছেড়ে দিয়ে পড়ে রইলাম। বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছি। চাচা সত্যি আমার কথা বিশ্বাস করেনি। কেউই করেনি। সবার ধারণা, হ্যালোউইনের জন্য দুর্দান্ত এক কস্টিউম নিয়েছি আমি। অথচ অপুর্ব(!) এই কস্টিউম ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে আমার দেহ।
কী করব এখন? পিঠ চুলকোচ্ছে, গায়ের থেকে যেন খসে পড়বে চামড়া।
শুয়ে থেকে বাহুর দিকে চাইলাম। নিজের বাহু বলে মনে হলো। না। কেটে ফেলতে ইচ্ছা করছে এটাকে। এটা আমার শরীরের অংশ নয়। আমার মাংসপেশী আটকা পড়েছে গাছের বাকলের নীচে। নড়াচড়া করতে পারছে না।
ফাঁদে পড়ে গেছি আমি!
জিনিসটা বুকের কাছে চলে এলে কী হবে? আমার শ্বাস-প্রশ্বাস কি থেমে যাবে? হৃৎপিণ্ডের কী অবস্থা হবে? মুখের ভিতরে পৌঁছে। গেলে কি আর কথা বলতে পারব? খিদে পেয়েছে আমার। কিন্তু এ খিদে অন্য খিদে।
মাটি খেতে সাধ হচ্ছে! জিভে জল আসছে মাটি খাওয়ার কথা ভাবলে। কিন্তু সেটা সম্ভব না! বালিশ এতটাই জোরে চেপে ধরলাম, ফ্যাকাসে হয়ে গেল আঙুলের গাঁট।
উহ্, এখানে এত গরম কেন? মনে হচ্ছে গরমকাল এখনও ফুরোয়নি।
উঠে গিয়ে বাথরূমের কল ছাড়লাম। ঝুঁকে পড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলাম পানিতে। পানি গিলছি। পেট ফুলে ওঠা না পর্যন্ত একটানা পান করলাম। মাটি খাওয়ার চাইতে এ-ও বরং ভাল।
এবার সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে চাইলাম।
ঘাড় থেকে মুখের দিকে চলে এসেছে বাকল।
ঘাড়ের কাছ থেকে সোয়েটশার্ট সরিয়ে দিলাম। এখানটায় এত গরম লাগছে কেন? আহা, নকুল ক্ষতের মত যদি এটাকে টেনে তুলে ফেলতে পারতাম! কিংবা যদি কেটে ফেলা যেত। কিন্তু কাজটা করতে সাহস হলো না। যদি দেখা যায় বাকলের নীচে শুধু হলদে দুর্গন্ধময় আঠা? কেটে ফেললে আবারও যদি গজায়? কিংবা গজাল না, কিন্তু হলদে তরল চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরোতেই থাকল, তখন?
এবার মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এল।
এটার হাত থেকে বাঁচার হয়তো আরেকটা উপায় আছে। পিছনের উঠনে এখনও পড়ে রয়েছে গুঁড়িগুলো।
সন্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে এসে গ্যারেজে ঢুকলাম। আমার হাতে চাচার কুঠার। এবার পা বাড়ালাম কাঠের গাদার উদ্দেশে। গুঁড়িগুলো আমার দুরবস্থার জন্য দায়ী। ওরা মৃত নয়। কিন্তু আমি যদি ওদেরকে মেরে ফেলতে পারি তা হলে হয়তো ওরা থামবে।
সূর্য ডুবে গেলেও আলো রয়েছে যথেষ্ট। ভারী, ভেজা কুয়াশা নেমে আসছে আকাশ থেকে। চারধারে চোখ বুলিয়ে, আগাছা ভেদ করে এগোলাম। ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে কেউ আমার অলক্ষে লক্ষ করছে আমাকে। আমি জানি কী সেটা।