চাচী আমার হাতে একটা বাদামি ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে, ঠেলে দিল। পিছনের দরজার দিকে।
অনেক বলে-কয়েও বাহুর দিকে চাচীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম না।
এখন স্কুলের সময়। সন্ধেয় তোর কাজ দেখব। এখন আর কোন অজুহাত নয়, সাফ জানিয়ে দিল চাচী।
আমার পিঠের উপর দরজা লেগে গেল দড়াম করে। চাচাকে বলে দেখা যেতে পারে। আচ্ছা, চামড়ার জিনিসটা যদি আরও ছড়ায়? যদি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তখন কী হবে? আমার সারা মুখ গাছের মত হয়ে যাবে না তো?
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাস স্টপে চলে এলাম।
বাসে একাকী বসে রইলাম। বাহু ঢাকা পড়েছে সোয়েটশার্টের তলায়। গোটা বাহু চুলকাচ্ছে, আর পুড়ে যাচ্ছে। বাকল ঘিরে মনে। হচ্ছে লাল পিঁপড়ে কামড়ে বেড়াচ্ছে। বাকলের নীচের অবস্থা আরও খারাপ। হাড় ব্যথা করছে। মাংসপেশী আড়ষ্ট। মুঠো শক্ত করতে কষ্ট হচ্ছে। আঙুলগুলো আঁকড়ে আসছে।
বাসে বসে রয়েছি, এক টুকরো বাঁকা কাঠের ছোট টুকরো বেরিয়ে এল নখের নীচ দিয়ে। বাঁ হাতের উপর ডান হাত চাপিয়ে দিলাম।
মুখ তুলে চাইতেই দেখি, এক ছেলে আমার দিকে চেয়ে। চোখ সরিয়ে নিল ও। মুখের চেহারা ছাই বর্ণ।
শার্টের হাতায় হাত ঢেকে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে চাইলাম।
বুকের মধ্যে ধড়াস-ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ড। এসব কী ঘটছে। আমার সঙ্গে?
স্কুলে পৌঁছে, সোজা নার্সের অফিসে গিয়ে ঢুকলাম।
কী, কিশোর, তোমার এবারের কস্টিউম কী? মমির অভিশাপ? নাকি পোড়া মুখ? নাকি আরও ভয়ংকর কিছু?
এক পা থেকে অপর পায়ে ভর সরালাম।
আমার শরীর খারাপ করছে।
আমাকে বসতে দিলেন নার্স। আমার তাপমাত্রা নিলেন। জিভ বের করতে বললেন। হার্টবিট কান পেতে শুনলেন। এবার আমার দিকে চাইলেন।
একদম সুস্থ।
বড় করে ঢোক গিলে বাহু বাড়িয়ে দিলাম। তারপর শার্টের হাতা গোটালাম। বাহুতে ছড়িয়ে পড়েছে শক্ত, বাদামি বাকল। শিকড়ের
কিলবিলে কী সব যেন বেরিয়ে এসেছে নখের তলা দিয়ে।
মিসেস গিলক্রিস্ট পিছু হটলেন। আমার বাহুর দিকে দুমুহূর্ত চেয়ে থেকে দরজার কাছে হেঁটে গেলেন।
ক্লাসে যাও। এসব স্টান্ট দেখিয়ে ছুটি পাবে না।
কিন্তু…
আর কোনও কথা নয়। তুমি কি চাও তোমার বাসায় ফোন করে কমপ্লেন করি?
অগত্যা হাতা টেনে বেরিয়ে এলাম।
ক্লাসে সবার শেষে ঢুকলাম আমি। চুপচাপ ডেস্কে গিয়ে বসলাম।
রবিন ঝুঁকে পড়ল ওর ডেস্ক থেকে।
বাসের কয়েকটা ছেলের কাছে তোমার কস্টিউমের কথা শুনলাম। কই, দেখি?
মিসেস হকিন্স আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন। চুপ করে গেল রবিন। পরে, বলল। ক্লাস শুরু হলো।
মিসেস হকিন্সের কোন কথা আমার কানে ঢুকছে না। বাহুর চুলকানিটা বন্ধ হয়েছে। এবার কাঁধে শুরু হয়েছে। চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পোকা হাঁটছে চামড়ার উপর দিয়ে। ডেস্কের নীচে বা হাত রাখলাম। সোয়েটশার্টের হাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছি। দেখতে চাই না আমি।
লাঞ্চ বেল বাজলে মুসা আর রবিন উঠে এল আমার কাছে।
কই, দেখি? বলল রবিন। তুমি করেছ নাকি রাশেদ চাচা করে দিয়েছেন?
উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা গোটালাম।
ঠাট্টা নয়, সত্যি।
তাই বুঝি? দেখাও না। বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। লাঞ্চ বেঞ্চির উদ্দেশে এগোলাম।
বেঞ্চে বসে বন্ধুদের দিকে চেয়ে রইলাম। ব্যাগ থেকে আপেল বের করে কামড় দিল মুসা। ওরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবে আমার কৃথা। করলে পাশে কাউকে পাব আমি।
চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে শার্টের হাতা টেনে উঠালাম।
রবিনের চোখ ছানাবড়া। মুখ হাঁ।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। আপেল নামিয়ে রাখল। ধরে দেখি?
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম।
আঙুল দিয়ে আমার বাহুতে মৃদু খোঁচা দিল ও।
হঠাৎই কান্না পেয়ে গেল। ওর স্পর্শ অনুভব করিনি আমি। ভারী ঠেকছে বাহু, ওটা যেন আর আমার নয়।
এটাই তোমার সেরা কস্টিউম…
মুসা, এটা কিন্তু সত্যিসত্যিই হয়েছে! চোখ কটমট করে চেঁচিয়ে উঠলাম।
হাত সরিয়ে পিছনে সরে গেল ও।
খেপছ কেন? তুমি এটা দেখিয়ে সবাইকে বোকা বানাতে চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব।
বোকা কোথাকার, বললাম তো এটা স্টান্ট নয়-সত্যি। তুমি তো হাত দিয়েই দেখলে। কাঠের মত। আমার সারা শরীর গাছ হয়ে যাচ্ছে। কাল রাতের ঘটনা ওদেরকে খুলে বললাম। কাঠ আনতে গিয়ে কীভাবে কামড় খাই। বাহুর দিকে তাকালাম। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল।
আমি একটু ছুঁয়ে দেখি, বলল রবিন। পরমুহূর্তে শিউরে উঠল।
আমার মনে হয় গুঁড়িটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে, বললাম।
দুর্দান্ত হয়েছে এবারের কস্টিউমটা, বলল রবিন।
তোমরা কেন বিশ্বাস করছ না? মরিয়ার মত বলে উঠলাম।
রবিনকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম। কিচকিচ করে উঠল বাহু, কনুই ভাঁজ করতে পারছি না।
মুসা আর রবিন অন্যান্য ছেলে-মেয়েদেরকে আমার কস্টিউমের। কথা বলতে গেল। একটু পরে দেখতে পেলাম আমাকে দেখিয়ে ওরা কী সব বলাবলি করছে।
খিদে নেই, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। আরেকটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। খানিক বাদে উঠে দাঁড়ালাম। খেলার মাঠের এক কিনারে গিয়ে বসে পড়লাম।
ওদিকে, টেবিলে বসে ছেলে-মেয়েরা আলোচনা করছে। হ্যালোউইনে তারা কী পরবে। বানোয়াট সব পোশাক। ধুলোয় আঙুল চালালাম। মিথ্যে সব কিছু এমুহূর্তে অসহ্য লাগছে আমার। ঘৃণা হচ্ছে হ্যালোউইনকে। এ ঘটনা বছরের অন্য কোন সময় ঘটলে এখন আমি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতাম। কিন্তু এখন হ্যালোউইনের আগে কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না।