হার্ট দৃষ্টিসীমার আড়াল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। এবার বাড়ির পিছনদিকের উদ্দেশে দৌড় দিলাম। দরজাটার কাছে এসে নবে মোচড় দিলাম। খোলা!
বেআইনীভাবে অন্যের বাড়িতে ঢোকার জন্যে জেল খাটতে হবে না তো? ফিসফিস করে বলল মলি
ভয় পেয়ো না। হার্ট নিজেই তো বেআইনী লোক। নিঃশব্দে প্রবেশ করলাম আমরা।
জঘন্য দশা বাড়িটার ভিতরে। ছাদ থেকে ঝুলছে বড় বড় মাকড়সার জাল। হাতে গোনা যে কয়টা ফার্নিচার রয়েছে, তার উপরে পুরু ধুলোর আস্তরণ। বাতাসে বাসি, দম বন্ধ করা গন্ধ। জানালা খোলা হয়নি যেন বহু বছর। ভাগ্য ভাল, ফ্ল্যাশলাইট সঙ্গে এনেছিলাম। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার।
আমরা এখন বাড়ির সামনের দিকে। কোনও সূত্র-টুত্র চোখে পড়েনি। লম্বা এক সার সিঁড়ি উঠে গেছে উপরতলায়। মলির দিকে চাইলাম। উঠব আমরা? মলির সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি আমি। ওর বাবা-মা খুবই ভাল ব্যবহার করেছেন আমার সঙ্গে। ওর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না… শিউরে উঠলাম ভাবনাটা মাথায় আসতেই।
মলি কনুইয়ের গুঁতো দিল আমাকে।
ওটা স্টাডিরূম মনে হচ্ছে।
ও ঠিকই বলেছে। একমাত্র ও জায়গাটাই বুড়ো ব্যবহার করে বলে মনে হলো আমার কাছে। চারধারে বইয়ের তূপ। তাক, বুককেস আর প্রকাণ্ড এক ডেস্কের উপরে বড় বড় মোমবাতি। সম্ভবত এখানেই বেশিরভাগ সময় কাটায় হার্ট।
ডেস্কের কাছে চলে এলাম। মানুষের হৃৎপিণ্ড সংক্রান্ত এক বই উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তারমানে আমার সায়েন্স প্রজেক্টে সাহায্য করতে চায় হার্ট। ইতিহাসের উপর ইয়া মোটা এক বইও দেখতে পেলাম। নাহ, বুড়ো খাটছে– আমার জন্য।
খাইছে, এসব কী ভাবছি আমি? ও তো আমাকে বশ করে ওর চামচা বানাতে চায়। আমার উপকারের জন্য তো কিছু করছে না।
কিন্তু আমাকে ও বেছে নিল কেন? উত্তরটা এখন আমি জানি। পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছিলাম, নিজেকে ফেলে দিয়েছিলাম ফাঁদে। ফাঁদে পড়া মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বেপরোয়া। তাকে দিয়ে সব কিছুই করানো সম্ভব। হ্যাঁ, ঠিক লোককেই বেছে নিয়েছে হার্ট।
মলির কথায় সংবিৎ ফিরে পেলাম।
এটা দেখো! খোলা এক নোটবই দেখাল ও। প্রথম পাতায়, হার্টের প্রাচীন হস্তাক্ষরে লেখা, গ্রীনহিলস শাসনের পরিকল্পনা। ওটা পড়ে মলির চাইতে কম চমকাইনি আমি।
বুড়োর কিছু একটা মতলব আছে জানতাম, কিন্তু তাই বলে তলে তলে। এত?
পাতা উল্টে গেলাম নোটটার। হার্টের উদ্ভট পরিকল্পনা সম্পর্কে একটা ধারণা পাচ্ছি: শহরের একমাত্র খবরের কাগজটার মাধ্যমে নাগরিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে সে। গোপনে কম্পিউটার ব্যবহার করে, সমস্ত আর্টিকল নিজের ইচ্ছে মত পরিবর্তন করবে, কোনও কোনওটা নতুন করে লিখবে। এভাবে পাঠকদের কাছে বিল হার্টকে উপস্থাপন করবে। এরপর ক্রমেই জোরাল হতে থাকবে তার বক্তব্য। সুযোগমত টিভি আর রেডিও সেন্টারও দখলে নিয়ে আসবে।
তার শাসন মেনে নিতে বলা হবে শহরবাসীকে। তার রাজত্বে নাকি। বেকার থাকবে না, অপরাধী থাকবে না, মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। ব্যাটা! পাগল আর কাকে বলে! একা একজন মানুষ, এভাবে কেউ কোনওদিন ক্ষমতা বিস্তার করতে পারে?
পড়াশোনা করা ভাল, মুসা। কিন্তু তাই বলে লোকের ব্যক্তিগত নোটবই?
আমি চমকে উঠলাম কেন? হার্টের স্বভাবই তো যখন-তখন উদয় হওয়া। হাত কাঁপছে, খসে পড়ে গেল নোটবইটা।
মলি চেষ্টা করেও আতঙ্কটা চাপা দিতে পারল না।
ব্যক্তিগত? গ্রীনহিলস দখল করে নিয়ে শাসন করতে চান, সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলো? বলে উঠল ও।
হ্যাঁ, গলা মেলালাম আমি।
এশহরটা আর সব শহরের চাইতে ভাল। কিন্তু এটাকে আরও ভাল করে গড়ে তোলা যায়। সেটাই চাইছি আমি। এরমধ্যে দোষটা কোথায়? আমার তো কারও ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই। আমার অধীনে সবাই সুখে থাকবে, একথা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
হার্টের কথায় প্রায় পটেই গিয়েছিলাম আমি। সত্যি বলতে কী, কথাগুলো শুনতে কিন্তু খারাপ নয়।
মলি আমার মনের কথা পড়ে ফেলল।
তার বিনিময়ে কী দিতে হবে শহরের বাসিন্দাদেরকে?
বেশি কিছু না, শুধু আমার শাসন নিঃশর্তে মেনে নিতে হবে। এবার আমার উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল ও। আমি কিন্তু তোমার আচরণে দুঃখ পেয়েছি, মুসা। তোমাকে বেছে নিয়েছিলাম আমাকে সাহায্য করার জন্যে। অথচ তুমি কিনা আমার প্ল্যান বানচাল করতে চাইছ! আমার এখন তোমাকে শেষ না করে উপায় নেই। এবং তোমার বান্ধবীকেও।
দশ
হাত দুলিয়ে একটা আলোকিত মোমবাতি হাজির করল হার্ট। আমার ভীতি এখন বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে। মলির দিকে চাইলাম। দুচোখে অশ্রু টলমল করছে ওর।
ওকে যেতে দিন। ও আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে হয় করুন। শুধু ওকে ছেড়ে দিন, প্লিজ। অনুনয় করে বললাম।
তোমার মনোভাবের প্রশংসা করতেই হয়। আমি রীতিমত মুগ্ধ। মলির দিকে চাইল পাগলা বুড়ো। আহারে, বেচারীর একদম কাঁচা বয়স। কিন্তু কী করব বলো, ও যে অনেক বেশি জেনে গেছে। মুখের চেহারা কঠোর হলো তার। এসো আমার সঙ্গে।
আমাদেরকে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে নেমে যেতে লাগল সরু এক সার সিঁড়ি ভেঙে। মলির হাত ধরলাম আমি। এর বেশি আর কীই বা করার আছে। আমার।
হঠাৎই রাগ উঠে গেল। কোথায় পালাল ভয়-ভীতি! আমাদেরকে শাস্তি দেওয়ার কে এই উন্মাদ বুড়োটা? নিজেকে কী মনে করে ও?