যাও না, যত খুশি চেঁচাও, সাহায্য চাও- কেউ শুনবে না। কেউ দেখবে না। আঙুলের তীক্ষ্ণ ডগা নাড়ল আমার উদ্দেশে। সত্যি বলতে কী, তুমি চলে যেতে চাও শুনে আমি কিন্তু বেশ অপমানিত বোধ করছি।
না, মানে আমার বাবা-মা দুশ্চিন্তা করবে কিনা। তা ছাড়া স্কুলের এক ছেলে আমার ওপর ভরসা করে বসে আছে। দুজন মিলে বিজ্ঞান মেলার জন্যে প্রজেক্ট তৈরি করার কথা।
তুমি যদি গ্রীনহিলসে ফিরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নিতে পারো, তবে বলতেই হবে তুমি আমার চাইতেও বড় জাদুকর। হাহ, হাহ্, হা। পরমুহূর্তে, বিদ্যুৎ ঝলকের মত উবে গেল বুড়ো।
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও হার মানতে রাজি হলো না মন। নিশ্চয়ই উদ্ধারের কোনও না কোনও রাস্তা আছে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, এই বিপদে আমি পড়লাম কীভাবে? খাইছে, একী!
এই যে, মুসা, এদিকে। কিশোরের কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ, এদিকে। রবিন বলে উঠল।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না, কিন্তু মনে হলো ওদের কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছে দেয়ালের কাছ থেকে হার্টের এক পোরট্রেটের পিছন থেকে। ছবিটা যে এঁকেছে তার প্রশংসা করতে পারলাম না। কেননা বুড়ো দেখতে মোটেই অমন সুন্দর নয়।
কোথায় তোমরা? প্রশ্ন করলাম মরিয়ার মতন।
তাড়াতাড়ি করো! সময় নেই। হার্টের ছবিটা নামিয়ে ফেলো। ওটার পিছনে একটা চাবি পাবে, জবাব দিল কিশোর।
ভারী ছবিটা নামাতে গিয়ে ধুলোয় দম আটকে মরার দশা হলো। দুহাতে জড়িয়ে গেছে মাকড়সার জাল। কিশোরের কথা মত পুরানো এক চাবি ঠিকই পাওয়া গেল ক্যানভাসের গায়ে। সাঁটিয়ে রেখেছে আঠা দিয়ে। টান মেরে খুলে আনলাম ওটা।
পেয়েছি, জানালাম।
আস্তে কথা বলো, বলল কিশোর। নইলে ওরা শুনে ফেলবে। ওই বুকশেলফগুলো দেখতে পাচ্ছ?
আগে খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন দেখতে পেলাম এক দিকের পুরো দেয়ালজুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তিন নম্বর তাকে, বইয়ের পিছনে একটা তালা আছে। চাবিটা ঢুকিয়ে বায়ে মোচড় দাও, নির্দেশ দিল কিশোর।
ওর কথা মত কাজ করলাম। খাইছে, দেয়ালের একাংশ ধীরে ধীরে খুলে গেল। কিশোর আর রবিন ওপাশে দাঁড়িয়ে।
তোমাদেরকে পেয়ে কী যে খুশি লাগছে! বলে উঠলাম।
আমাদেরও। কিন্তু এখন একটা মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না। দরজাটা লাগিয়ে দাও, জরুরী কণ্ঠে বলল রবিন।
আমরা যাচ্ছি কোথায়? প্রশ্ন করলাম।
এই সুরঙ্গ দিয়ে ফিরে যাব পৃথিবীতে, জানাল কিশোর।
তুমি এতসব জানলে কীভাবে? এস্ত পায়ে হাঁটার ফাঁকে জিজ্ঞেস। করলাম। তোমরা কতক্ষণ ছিলে এখানে? এই কদিন আগেই না ফোনে কথা হলো?
পরে সব শুনো।এখন জলদি চলো, তাগাদা দিল নথি।
সুরঙ্গটা অন্ধকার আর সেঁতসেঁতে। ভয়-ভয় করছে। বন্ধুদের মনের অবস্থাও সহজেই অনুমান করা যায়। হঠাৎই গমগম করে উঠল একটি কণ্ঠস্বর।
চললে কোথায়?
ধড়াস করে উঠল বুকের ভিতরটা। আমাদের সামনে যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হলো হার্ট, আপাদমস্তক কুয়াশায় ঢাকা। মুখের চেহারা থমথম করছে, বুকের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে বাহু ভাঁজ করা। আগে লক্ষ করিনি, ওর ডান হাতের আঙুলে শোভা পাচ্ছে প্রকাণ্ড এক হীরের আংটি। ওটা এতটাই উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে, কপালে হাত রেখে ছাউনি তৈরি করতে হলো আমার।
আমার পিছন পিছন এসো।
সাত
না! চেঁচিয়ে উঠলাম। না!
মুসা, মুসা, উঠে পড়ো।
এক চোখ মেলে পিটপিট করে চাইলাম। সোফা বেডে শুয়ে আছি। মিস্টার ও মিসেস ল্যাম্পার্ড, মলি, এমনকী খুদে লরাও উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে। তড়াক করে উঠে বসলাম। পিঠে অনুভব করলাম উষ্ণ রোদ। কেমন জানি বিভ্রান্ত, অপ্রস্তুত বোধ করছি।
কঠিন দুঃস্বপ্ন দেখেছ মনে হচ্ছে, মলি বলল।
তুমি ভাল আছ তো, মুসা? মিসেস ল্যাম্পার্ড প্রশ্ন করলেন। উদ্বেগ প্রকাশ পেল কণ্ঠে।
মাথা ঝাঁকালাম। অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অন্যের বাড়িতে কে চায় এরকম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে?
নাস্তা খেতে এসো, বললেন মিসেস ল্যাম্পার্ড। তোমরাও এসো।
মলি গেল সবার শেষে।
আজকের আবহাওয়াটা চমৎকার, মুসা, বলল ফিসফিস করে। হানাবাড়িতে হানা দেয়ার জন্যে একেবারে পারফেক্ট।
গুঙিয়ে উঠলাম। ওকে বোঝাব কী করে যে দশটা বুনো ঘোড়াও আমাকে ১০০ মেইন স্ট্রীটে টেনে নিয়ে যেতে পারবে না?
সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবা-মা ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর অজুহাত দেখাব তারা বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছে না। কিন্তু মলি ভাল মেয়ে। ওকে ঠকাতে মন চাইল না। মুখ-টুখ ধুয়ে নতুন কাপড় পরলাম, সেঁটে নাস্তা করার পর মনটা খোশ হয়ে গেল।
আমার সাইকেলটা বাসায়। মলির সঙ্গে ওদের ড্রাইভওয়ের সামনে দেখা করব ঠিক করলাম। আমাদের গ্যারেজের উদ্দেশে এগোলাম। কম্বিনেশন লক চেপে দরজা খুললাম।
পা রাখলাম ভিতরে। বাইকের কাছে হেঁটে গিয়ে কিক স্ট্যান্ডে লাথি মারতে যাব, আচমকা খটাস করে লেগে গেল গ্যারেজের দরজা। এরকম হওয়ার তো কথা নয়! কালিগোলা অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
ভড়কে গেছ, তাই না? সেই কণ্ঠস্বর আবার!
হার্টকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ঠিক হাজির হয়ে গেছে সে।
দেখুন, আপনি কিন্তু না বলে ঢুকেছেন আমাদের বাড়িতে। ভালয়-ভালয় চলে যান, নয়তো পুলিশ ডাকব।
আহাহা, বন্ধুর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? তোমাকে কতখানি সাহায্য করেছি এরই মধ্যে ভুলে গেলে?