রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে নিজের রুমে ঢুকেছি, ক্লজিটের কাছে কিছু একটা কিংবা কেউ একজন গুটিসুটি মেরে রয়েছে দেখতে পেলাম। খাইছে! কম্পিত হাতে আলো জ্বালোম।
একগাদা ময়লা কাপড় ওখানে জড় করে রেখেছিলাম। নিজেই ভুলে গেছি। নাহ, বিল হার্ট আমাকে পেয়ে বসেছে! ভেবেছিলাম ও-ই বুঝি ঘরের কোণে হাজির হয়ে আমাকে ভয় দেখাতে এসেছে।
শুক্রবার দিনটা খুব স্বাভাবিকভাবে কাটল। ক্লাসে বিশেষ কোনও ঘটনা ঘটেনি, কেউ আচমকা মাটি খুঁড়ে উদয় হয়নি। মনটা খারাপই হয়ে গেল। আশা করেছিলাম নিশ্চয়ই অদ্ভুত কোনও ঘটনা ঘটবে। রাতে ঘুমানোর সময়। ধারণা করলাম, বিল হার্ট সম্ভবত শহর ত্যাগ করেছে।
শনিবার ঘুম ভাঙার পর ঝরঝরে বোধ করলাম। আজ কাগজ দিচ্ছি না। এক ছেলে বাড়তি পয়সা কামানোর জন্য আমার রুটে কাজ করার অনুমতি চেয়েছিল, আমি আপত্তি করিনি।
বাবা-মা আজ রাতে পার্টিতে যাবে। তাই মা আমাকে গাড়িতে করে ভিডিওর দোকানে নিয়ে গেল ছবি বাছাই করতে।
সন্ধেবেলা পপকর্ন, চিপস আর এক মগ সোডা নিয়ে ছবি দেখতে বসলাম। মনের যা অবস্থা তাতে দুটো ছবির মধ্যে কমেডিটাই আগে দেখব ঠিক করলাম।
ভিসিআর চালু করলাম, কানে এল নানা ধরনের বিচিত্র কাঁচ-কাঁচ শব্দ। সিঁড়ি, ছাদ, দেয়াল- সবখান থেকে শব্দ আসছে। বাবা বলে এর মানে হচ্ছে বাড়িটা থিতু হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাড়িটা তো যথেষ্ট পুরানো। এতদিনেও থিতু হতে পারল না?
ভিসিআরের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে গা এলিয়ে বসতে চেষ্টা করলাম। ইস, কিশোর আর রবিন থাকলে কী ভালই না হত! তিনজন একসঙ্গে থাকলে ভয়-ডর কোথায় পালাত! রবিবার মলির সঙ্গে দেখা করার কথা। মনটা দমে গেল। কাজটা সেরে ফেলতে হবে ঝটপট। হার্ট মনে হয় শহরে নেই, কাজেই মলির দেখার মত কিছু পাওয়াও যাবে না ও বাড়িতে। বাড়ির বাইরে দিয়ে দ্রুত এক পাক মেরে ফিরে আসতে হবে।
আরে ধুর, সাত-পাঁচ ভাবতে গিয়ে ছবির খেই হারিয়ে ফেলেছি। রিওয়াইন্ড করতে হবে খানিকটা। এসময় শব্দ হলো আবারও। মাথার উপরে ককিয়ে উঠল মেঝের কাঠ। মনে হলো বাড়িতে আমি একা নই, কেউ একজন আছে আমার সঙ্গে।
ঘড়ি দেখলাম। আটটা বাজে। বাবা-মার ফিরতে আরও কয়েক ঘণ্টা দেরি। ধ্যাত্তেরি, এসব নিয়ে মাথা ঘামাব না। খেই হারানো জায়গাটা খুঁজে পেয়ে ছবিতে মন দিলাম।
বাইরে বাতাসের দাপাদাপি। গাছের ডালে ডালে বাড়ি খাচ্ছে খটাখট। হঠাই জানালার শার্সিতে আঘাত হানল কী যেন। চমকে উঠলাম। ঘুরে বসে খড়খড়ি তুলে দিলাম। কিন্তু জানালার কাঁচে গাল ঠেকিয়েও কিছু দেখতে পেলাম না।
সহসা আমার শ্বাসের বাষ্প থেকে একটা মুখাবয়ব ফুটে উঠল। জানালার ওপাশ থেকে সরাসরি আমার দিকেই চেয়ে রয়েছে বিল হার্ট!
পাঁচ
খড়খড়ি হাতড়াতে লাগলাম, মরিয়ার মত নামাতে চাইছি। কাজটা সেরে টিভি অফ করলাম। এটা কমেডি দেখার সময় নয়। পিছনের দরজার সঙ্গে একটা চেয়ার ঠেকনো দিলাম। পুলিশে খবর দেব? লাভ হবে না। ওরা যখন পৌঁছবে হার্ট ততক্ষণে হাওয়া। সামনের দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে চিৎকার শুরু করব নাকি? নাহ, লোক হাসিয়ে কাজ কী।
এ মুহূর্তে হাতে একটা অস্ত্র-টস্ত্র থাকা উচিত। ঘরের চারদিকে নজর বুলিয়ে নিলাম। বুক এতটাই ধড়ফড় করছে, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাও করতে পারছি না।
শব্দটা কীসের? মাথার উপরে এলোমেলো পায়ে হাঁটছে কেউ। কে? হার্ট? না। ও উপরে যাবে কেন? ও তো বাইরে। নির্ঘাত অন্য কেউ ঢুকে বসে আছে।
আমি আত্মরক্ষা করব কী দিয়ে? কিছু খুঁজে না পেয়ে অগত্যা তুলে নিলাম রিমোট কন্ট্রোলটা। আর কিছু না হোক, কষে বাড়ি তো দিতে পারব।
পায়ের শব্দ এখন সিঁড়িতে। ধীরে ধীরে নেমে আসছে, লুকানোর জায়গা দরকার। বাবার লাউঞ্জ চেয়ারটা কাজে দেবে মনে হলো। কামরার কোনায় রয়েছে ওটা। অনায়াসে গা ঢাকা দেয়া যাবে চেয়ারটার পিছনে। অনাহূত অতিথি আমাকে দেখার আগেই আমি তাকে দেখতে পাব। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে অপেক্ষায় রইলাম।
হঠাই টেলিফোনের শব্দে আঁতকে উঠতে হলো। একটানা বেজেই চলেছে। অবশেষে থামল, তবে মাত্র এক মিনিটের জন্য। টেলিফোন যে করেছে তার জরুরী দরকার মনে হচ্ছে। কালকের ট্রিপের ব্যাপারে মলি করল নাকি? কিশোর কিংবা রবিন করেনি তো আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য?
টেলিফোনটা আর গোটা বাড়ি হঠাৎ করেই নিঝুম হয়ে গেল। কানে আসছে কেবল মুষলধারে বৃষ্টি আর বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। আশা করলাম, খারাপ আবহাওয়ার কারণে হার্ট তার হানাবাড়িতে ফিরে যাবে।
পায়ে খিল ধরে যাচ্ছে, কিন্তু নড়ার সাহস পেলাম না। এই যাহ, বাতি চলে গেল! পাওয়ার ফেইল করেছে নাকি কেউ ইচ্ছে করে কাজটা করল বুঝতে পারলাম না। রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে টিভি অন করার চেষ্টা করলাম। হলো না।
বুকের মধ্যে আতঙ্ক ক্রমেই জমাট বাঁধছে।
এসময় সদর দরজায় টোকার শব্দ হলো। পরপর তিনবার। উঠে দাঁড়ালাম, পা কাঁপছে। কে এল এই দুর্যোগের মধ্যে? হার্ট না তো? আমার নাম ধরে ডাকছে। না, হার্ট না অন্য কেউ।
মুসা, আছ নাকি? আমি মিস্টার ল্যাম্পার্ড।
মলির বাবা। বাঁচলাম, বাবা!
আঁধারে হাতড়ে হাতড়ে সদর দরজার কাছে পৌঁছলাম। খুলে দিলাম।
ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি? প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।