হঠাত্র একটা কথা মাথায় আসতে মনটা দমে গেল। কাল সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হোমওয়র্ক করার আগেই। আতঙ্ক জেঁকে বসল মনের মধ্যে। ইংরেজি ক্লাসের জন্য সংক্ষিপ্ত রচনা, দশটা অঙ্ক এবং বিজ্ঞান মেলার জন্য প্রজেক্ট তৈরির পরিকল্পনা কিছুই করা হয়নি। আর এখন গিয়ে যে হোমওয়র্ক করতে বসব তারও উপায় নেই। এক গাদা কাগজ এখনও বিলি করা বাকি।
অবশেষে স্কুলে পৌঁছলাম। ক্লাসের সবাই একে একে মিসেস রোজের ডেস্কে তাদের লেখা জমা দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষমেশ এগিয়ে গেলাম টিচারের উদ্দেশে। তাকে জানালাম, শরীর খারাপ ছিল বলে রচনা লিখতে পারিনি। আবার একটা অর্ধসত্য ঝাড়তে হলো।
কী বলছ তুমি, অবাক কণ্ঠে কাগজের স্তূপের দিকে চাইলেন তিনি। তোমার লেখাটাই তো সবার ওপরে।
খাইছে! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু স্বচক্ষে যা। দেখছি তাকে অস্বীকার করি কীভাবে? আমার হাতের লেখায় একটা রচনা সত্যিই রাখা আছে ওখানে। কান গরম হয়ে গেল আমার। মিসেস রোজ হতভম্বের মত আমার দিকে চেয়ে।
কোনও সমস্যা, মুসা? আমাকে বলতে পারো।
এস্তপায়ে ডেস্কের দিকে ফিরে চললাম।
জি না, কোনও সমস্যা নেই। ভুলে যাইনি যে সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম। মানে হোমওয়র্কের কথা বলছি আর কী।
ভাগ্যিস কেউ আমার আবোল তাবোল বকুনি শোনেনি। নিজেকে বড়ই বোকা আর বিভ্রান্ত লাগছে।
এবং ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হলো। অঙ্কের হোমওয়র্ক সারা হয়ে গেছে। সায়েন্স প্রজেক্টের নকশাও তৈরি। বাস্কেটবল প্র্যাকটিসের পর বাইকে চেপে যখন বাড়ির পথ ধরলাম, মনে হলো কোনও ফেরেশতা বুঝি সাহায্য করছে আমাকে। আর করবে না-ই বা কেন? আমি কি ছেলে হিসেবে খারাপ?
সাইকেল চালাচ্ছি নির্জন এক গলি ধরে। শর্টকাট হয় এপথে এলে। এখানে পৌঁছে গতি বাড়িয়ে দিই আমি। কেননা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটায় কেমন জানি ভয়-ভয় করে।
সামনের চাকায় একটা ন্যাকড়া জড়িয়ে গেছে। ব্রেক কষলাম। ঝুঁকে পড়ে ওটা সরাতে গেছি, চোখের কোণে লক্ষ করলাম কী যেন নড়ে উঠল একটা গাছের পিছনে। বুকটা ধড়াস করে উঠল লোকটিকে চিনতে পেরে।
সরি, আজকে ভোরে তোমার সাথে দেখা হয়নি। অবশ্য হোমওয়র্ক করতে বেশ সময় লেগে যায়, এমনকী আমারও। যাকগে, তোমার টিচাররা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন?
ভয় পেয়েছি তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু হার্টকে সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। মুখটাকে কঠোর করে বুড়োর চোখে চোখে চাইলাম।
কে আপনি? কী চান? আমার হোমওয়র্ক করে দিচ্ছেন কেন? গ্রীনহিলসে এত ছেলে-মেয়ে থাকতে আমাকে এত খাতির কীসের?
খলখল করে চেনা হাসিটা হেসে উঠল বুড়ো। শিউরে উঠলাম।
আমাদের ঠিকমত পরিচয় হয়নি। তুমি বোধহয় জেনে গেছ আমি বিল হার্ট। তোমার প্রথম প্রশ্নের জবাব পেলে। আর আমি কী চাই সেটা সময় হলেই জানতে পারবে।
উধাও হয়ে গেল সে। আমার কপট সাহসও উবে গেল কর্পূরের মত। এতটাই কাঁপছি, বাইকে চড়তে কষ্ট হলো রীতিমত। বাড়ির উদ্দেশে পেডাল মারছি, হার্টের খেপাটে হাসিটা বেজে চলল মাথার মধ্যে বারে বারে।
তিন
হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি এসে পৌঁছুলাম। হাঁপানোরই কথা। বাইক রেসে বিশ্ব রেকর্ড করেছি কিনা আজ।
কিশোর আর রবিনের কথা খুব মনে হচ্ছে। ওদের সঙ্গে আলাপ করা দরকার। হিরন চাচার বাসায় ফোন করলাম।
একবার রিং বাজতেই রিসিভার তুলল কিশোর। ওর হ্যালো শোনামাত্র বুকটা ভরে গেল।
হাই, কিশোর। আমি মুসা।
আরে, কী খবর? কেমন আছ?
ভাল। তোমরা?
ভাল। রবিন একটু বাইরে গেছে। সব কেমন চলছে ওখানে?
এই তো, চলছে আরকী। হাতে সময় আছে তো?
নিশ্চয়ই। কী বলবে বলে ফেলো। মনে হচ্ছে ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটেছে।
এই না হলে বন্ধু। ঠিক ধরে ফেলেছে কিশোর। ওকে হার্ট ও আজগুবী ঘটনাগুলোর কথা খুলে বললাম। একটা শব্দও অবিশ্বাস করল না ও।
তো তোমার কী মনে হয়? প্রশ্ন করলাম।
সাবধানে থেকো। লোকটা পাগল-টাগল হতে পারে। ওকে কাগজ না। দিলে হয় না?
হাত খরচার ব্যাপারটা ভুলে যেয়ো না।
বেবি সিটিং করতে পারো, প্রস্তাব করল গোয়েন্দাপ্রধান।
পরমুহূর্তে হেসে উঠলাম দুজনেই। বছরখানেক আগে ম্যাকলিনদের দুই ছেলেকে বেবি সিট করি আমি। তিন আর পাঁচ বছরের বাচ্চা দুটো পুরো বাড়িটাকে তছনছ করে ছেড়েছিল। ওদের পরবর্তী শিকার ছিলাম আমি। প্রাণের দায়ে কিশোরকে ফোন করি। ও তক্ষুনি চলে আসে। ছেলে দুটোকে ভিডিও দেখতে বসিয়ে দেয় আর আমি সেই ফাঁকে বাড়িটা গোছগাছ করে ফেলি। মিসেস ম্যাকলিন ডেন্টিস্টের কাছ থেকে ফিরে দেখেন বাচ্চারা টিভির সামনে ঘুমাচ্ছে। তিনি মহাখুশি হন দৃশ্যটা দেখে। আমি আর কিশোর দুজনেই সম্মানী পাই। সত্যি বলতে কী, মিসেস ম্যাকলিনের সুপারিশের জোরেই খবরের কাগজের কাজটা জুটে যায় আমার।
মাকে লন্ড্রিরূম থেকে উপরে উঠে আসতে শুনলাম। কিশোরকে জানালাম, শীঘি আবার কথা হবে।
হ্যাঁ, বলল ও। ফোন করাতে খুব খুশি হয়েছি। আমার কথাগুলো মনে রেখো। আর কী হলো আমাকে জানিয়ো।
রিসিভার রেখে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। কিশোরের সঙ্গে কথা বলে মনটা হালকা লাগছে। কিন্তু আমাকে তো হার্টের সঙ্গে ঠিকই বোঝাপড়া করতে হবে। বাবা-মাকে কিছু জানানোর দরকার নেই। পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছি, অথচ জাদুবলে ভাল ফল করছি শুনলে তারা বিশ্বাস করবে না। আমাকে সোজা ধরে নিয়ে যাবে মনোচিকিৎসকের কাছে। না, ব্যাপারটা আমার একারই সামলাতে হবে।