একটু পরে, বেল বেজে উঠল। মাথা থেকে সরিয়ে দিলাম বিল হার্টের চিন্তা।
তবে সেটা বেশিক্ষণের জন্য নয়।
দুই
আমাদের পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটে এসেছে। মলি নামে এক মেয়ে আছে তাদের। আমার বয়সী। সবজান্তা ধরনের। ওর সঙ্গ বিরক্তিকর লাগে। আমার।
যা হোক, বাইক চালিয়ে ড্রাইভওয়েতে যেই ঢুকেছি, ওদের দরজা দিয়ে মাথা বের করল মলি। আমার অপেক্ষাতেই ছিল যেন।
তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
করলেই তো। বাইকটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে ঝটপট সটকে পড়ার ইচ্ছা। প্রশ্নের জবাব দিতে ভাল লাগে না আমার। তা ছাড়া মলি ঠিক সময়টাও বেছে নেয়নি।
যা বলার বলে ফেলো, বললাম। আমার প্রিয় টিভি শো এখুনি শুরু হয়ে যাবে। ওকে অবশ্য সে কথা জানালাম না।
আচ্ছা, এখানে নাকি একটা ভুতুড়ে বাড়ি আছে? প্রশ্ন করল ও।
কে বলেছে?
সেদিন কয়েকটা ছেলে-মেয়ে বলাবলি করছিল। আমি অবশ্য ওদের কথা বিশ্বাস করিনি। তবে ওদেরকে খুব সিরিয়াস দেখাচ্ছিল।
ভুতুড়ে বাড়ি আবার কী? খেঁকিয়ে উঠলাম প্রায়। কল্পনায় অবশ্য বিল হার্টের ছবি ঝিলিক দিয়ে গেল। বারান্দায়, হলওয়েতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। এ মুহূর্তে আমি বিল হার্ট আর মলির কাছ থেকে নিস্তার চাই।
কী ব্যাপার? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ভূত দেখেছ?
কথাগুলো ঘাই মারল মাথার মধ্যে।
আমি খুব ক্লান্ত। খিদেও পেয়েছে। তুমি এসব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও তো।
ঠিক এসময় মা দরজা দিয়ে উঁকি দিল।
তোরা ভেতরে আয়। কোকো বানিয়েছি।
ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল মলি।
বিকেলটা আমি তোমাদের বাসায় থাকছি। আমার বোনকে নিয়ে মা ডাক্তারের কাছে গেছে।
অতিকষ্টে বিরক্তি চাপা দিলাম। আজকেই কিনা মলিকে এসে জুটতে হলো! কোথায় মনটা হালকা করার জন্য টিভি দেখব তা না, এখন ওকে সময় দিতে হবে। কাকে? যে আমাকে আজ সারাদিনের অদ্ভুতুড়ে ঘটনাগুলো নিজের অজান্তেই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
কোকোটা যথেষ্ট গরম। একবার ভাবলাম ওটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাই, কিন্তু মা সেটা পছন্দ করবে না। অতিথির সঙ্গে অভদ্রতা করলে কপালে খারাবি আছে। কিন্তু কীসের অতিথি? আমি ওকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছি নাকি?
অগত্যা মলির সঙ্গে বসে থাকতে হলো। ও একঘেয়ে সুরে পড়াশোনার গল্প করে যাচ্ছে। কবে কী গ্রেড পেয়েছে শুনে বুঝলাম মেয়েটি ছাত্রী হিসেবে ভাল। শেষমেশ যখন ভাবছি ওর কথা ফুরিয়েছে, দেখি আমার নোটবইয়ের দিকে চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। ওটার ভিতর থেকে বেরিয়ে আছে আমার ইতিহাসের উত্তরপত্র।
আমি শুধু নিজের কথা বকে যাচ্ছি, অথচ তুমি এ-প্লাস পেয়ে বসে আছ, বলল।
মা সিঙ্কে কাপ ধুচ্ছিল, ঘুরে দাঁড়াল।
কীরে, এত ভাল করেছিস কিছু বললি না যে?
বলিনি কারণ আমি নিজে তো কিছুই করিনি। যা ঘটেছে সেটা ব্যাখ্যা করব কীভাবে? পরীক্ষার জন্য যদি তৈরি হয়েও যেতাম, এত ভাল করতে পারতাম? প্রশ্নই ওঠে না। মা এখন আশা করবে আমি সব পরীক্ষাতেই ভাল। করতে থাকব আমার পক্ষে যেটা অসম্ভব। এই মলি মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়া। কী দরকার ছিল তোর এত বকবক করার? আর আমিই বা কাগজটা লুকিয়ে রাখলাম না কেন? কাগজটা নষ্ট করে ফেলব আমি, কিন্তু তার আগে উত্তরগুলো পড়ে দেখতে হবে নিজের ঘরে গিয়ে!
মা আমার গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে, সারা মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত। হাত বাড়ানো। কাগজটা নোটবই থেকে টেনে বের করেছি, দেখি অপরিচিত অদ্ভুত হস্তাক্ষরে কী সব যেন বিজি বিজি করে লেখা। মা দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে এখন পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু গ্রেড সম্পর্কে মন্তব্য করার পর সরু হয়ে এল মায়ের চোখজোড়া।
জ্ঞানই শক্তি। বি, এইচ। ঠিক কথা। কে রে এই বি, এইচ?
স্কুলে নতুন এসেছে, কোনওমতে আওড়ালাম। পুরোপুরি মিথ্যে বলা হলো না।
মলি- মিস নাক গলিয়ে- সাগ্রহে নোটটা দেখছে।
এটা কী ধরনের হাতের লেখা? দেখে মনে হচ্ছে মধ্য যুগের লোক।
মজা করে লিখেছে। মায়ের কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে এক দৌড়ে উপরে, নিজের ঘরে চলে গেলাম। দরজা লাগিয়ে দিয়ে চোখ রাখলাম আয়নায়। মলি ঠিকই বলেছে। আমাকে আতঙ্কিত দেখাচ্ছে। দেখাবেই তো, ভয় তো পেয়েছি।
বিছানায় বসলাম। একা হতে পেরে স্বস্তি বোধ করছি। চারদিকে নজর বুলালাম। ঘরের কোথাও কোনও পরিবর্তন নেই, অথচ আমার কেমন জানি বিচিত্র এক অনুভূতি হচ্ছে। অস্বাভাবিক এক দিন কাটল আজ। কিশোর আর রবিনও নেই যে ওদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করব। উইকএন্ডে হিরন চাচার বাসায় বেড়াতে গেছে ওরা। এখনও আসেনি। আমি যেতে পারিনি কাগজ দিতে হয় বলে।
দরজায় ঢৌকা পড়তেই চমকে উঠলাম। মা এসেছে।
তোর শরীর ভাল তো, মুসা?
হ্যাঁ, মা। একটু ক্লান্ত শুধু। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে।
ঠিক আছে। কিছু লাগলে বলিস।
আচ্ছা।
ভয়ানক ক্লান্তি লাগছিল। খানিকক্ষণের মধ্যেই সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল তখন অন্ধকার। নাইট টেবিলে রাখা ঘড়িটা দেখলাম। তিনটে বাজে!
ভীষণ খিদে পেয়েছে। মুখ ধুয়ে নীচে নেমে এলাম।
কাউকে না জাগিয়ে বড় এক বাটি দুধ আর সিরিয়াল নিলাম। খাওয়া সেরে ঠিক করলাম বেরিয়ে পড়ব কাগজ বিলি করতে। একটু আগেভাগেই বেরোতে চাইছি, বিল হার্টকে যদি এড়াতে পারি সেই আশায়।
ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে গিয়ে দেখি আমিই প্রথম। আজ সবার আগে বিল হার্টের বাসায় গেলাম। তার দেখা পেলাম না। বারান্দা লক্ষ্য করে কাগজ ছুঁড়ে দিলাম। ঠিক জায়গায় পড়ল কিনা দেখার জন্য দাঁড়ালাম না। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। নিজের চালাকিতে মৃদু হাসি ফুটল ঠোঁটে। মন বলছে, আজকের দিনটা ভাল কাটবে।