তারপর দুইয়ে-দুইয়ে চার মিলিয়ে এখানে চলে এসেছে ওরা।
এখন প্রথম কাজ হচ্ছে, এখান থেকে পালানো। কোনও আইডিয়া? প্রশ্ন করলাম।
আমরা সংখ্যায় বেশি। এটাকে কাজে লাগাতে হবে, বলল রবিন।
ওর ক্ষমতা আরও বেশি। ভুলে যেয়ো না, ও জাদুকর, তা ছাড়া বদ্ধ উন্মাদ, বলল মলি।
ওই বিশ্রী জানালাটা ভেঙে ফেলি এসো, প্রস্তাব করলাম আমি। ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে কাজটা করা যেতে পারে।
শব্দ হবে। ট্র্যাপ ডোর আছে কিনা খুঁজে দেখি বরং, বলল কিশোর। হয়তো আছে, হার্ট জানে না।
পরমুহূর্তে তল্লাশী শুরু করলাম আমরা। লজ্জিত বোধ করছি আমি। আমার জন্যই সবাই মিলে এখন বিপদের মধ্যে পড়েছে। কী দরকার ছিল আমার ওদেরকে হার্টের কথা জানাতে যাওয়ার? বুড়োর সঙ্গে বোঝাপড়া যা করার আমিই না হয় করতাম। যাকগে, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আমার দায়িত্ব, বন্ধুদেরকে নিয়ে এখান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া।
বুড়ো কিশোর আর রবিনকে এখানে নামানোর পর সেলারের দরজা লাগিয়েছিল? ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। শ্বাস চেপে রেখে, সন্তর্পণে সিঁড়ির মাথায় উঠে এলাম। দরজার নব ঘোরালাম। বন্ধ, তবে কজাগুলোকে ততটা শক্ত মনে হলো না। হয়তো আলগা করা যাবে।
শব্দ হতে পারে, এই ভয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে চাইলাম না। তার বদলে, বন্ধুদেরকে ফিসফিসিয়ে বললাম, বল্ট খোলার মত কিছু একটা পায় কিনা খুঁজে দেখতে। খুঁজল ওরা, কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া গেল না।
এ দিকে রবিনের চোখে পড়েছে, ফাটা এক পাইপ বেয়ে টপ-টপ করে পানি ঝরছে।
পানিটা ধরে রাখা দরকার, বলল ও। হয়তো খাওয়া যাবে না, কিন্তু অন্য কাজে লাগতে পারে।
একটা ভাঙাচোরা বালতি খুঁজে পেয়ে মলির হাতে দিলাম।
পানি থিয়োরি প্রয়োগ করে দেখা যাক, কাজ হয় কী না, নেমে এসে বললাম ঠাট্টা করে।
পাইপের নীচে বালতিটা রাখল মলি। টিনের উপর পানি পড়ার শব্দ জোরাল হয়ে উঠলে, একটা ছেঁড়া কম্বল দিয়ে বালতির তলা মুড়ে দিল। শব্দ থামলেও পানি জমতে এখন সময় নেবে। কেননা, কম্বল শুষে নিচ্ছে পানি। কিন্তু মলির বিষণ্ণ মুখের চেহারা আমাকে বিচলিত করে তুলল। ও কী ভাবছে। বুঝতে বেগ পেতে হলো না। আমরা কি আদৌ কোনওদিন বেরোতে পারব এখান থেকে?
চরম হতাশায় কাঠের এক বীমে কষে লাথি ঝাড়লাম আমি। জিনিসটা এতটাই প্রাচীন, গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল থরথর করে। খাইছে! একটু পরেই দেখি হন্তদন্ত হয়ে হার্ট এসে হাজির। খেপে আগুন।
তোমরা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছ। তোমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করার এই ফল?
ভাল ব্যবহার-? জীবনে এত অবাক হইনি আমি। রেগে গিয়েছি। ভীষণ।
এখন আর মাফ চেয়ে কাজ হবে না, বাধা দিয়ে বলল হার্ট। আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আমার উদ্দেশে চোখ টিপল বুড়ো।
খাইছে! বুঝে গেছি এরপর কী ঘটতে চলেছে। হাত দোলাল ও, পরমুহূর্তে হাতে এসে গেল লম্বা এক দড়ি। এবার তর্জনী উল্টে, বাংলা ছবির ভিলেনের মত কাছে ডাকল মলিকে। বেচারী ভয়ে আধমরা। আমার পিছনে আড়াল নিল।
আমি আগেও বলেছি, হার্ট। ওকে ছেড়ে দিন।
কেন বুঝতে পারছ না, আমি চাইলে অনেক আগেই তোমাদের ক্ষতি করতে পারতাম। এই খাম্বার সাথে তোমাদের বেঁধে রাখব। তোমাদের ভালর জন্যই। তা হলে আর কোনও বিপদ-আপদ হবে না তোমাদের। দুপা এগিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল মলির উদ্দেশে। এসো, বাছা।
কিশোর কাছিয়ে এসেছে আমার দিকে। এক হাতে তখনও কমলার রস শক্ত করে ধরা, অপর হাত বাড়াল আমার কাছ থেকে ফ্ল্যাশলাইটটা নেওয়ার জন্য। বুঝলাম, বুড়োর মাথায় বাড়ি মারতে চায়। কিন্তু ওতে যে কাজ হবে না মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।
তার বদলে আরও শক্ত করে ধরে থাকলাম ফ্ল্যাশলাইটটা। ও ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ওটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করল। তার ফল হলো এই, বুড়ো। হার্টের সারা শরীরে চলকে পড়ল কিশোরের কমলার রস।
নড়বারও সাহস পেলাম না আমরা। তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে আশঙ্কা করেছিলাম, ভাবিনি অমন তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পাব।
হার্ট বুড়ো গর্জাচ্ছে আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
বাঁচাও, কোনমতে আওড়াতে পারল। আমার চামড়া পুড়ে যাচ্ছে আ-গু-নে।
আগুনের শিখা নেই, কিন্তু মৃদু ফট-ফট শব্দ শুনতে পাচ্ছি। নাকে এল মাংস পোড়া গন্ধ।
এবার আমাদের চোখের সামনে, ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে শুরু করল খেপা জাদুকর। খাইছে!
অ্যাসিড! আর্তনাদ ছাড়ল। অ্যাসিডে আমার মাংস পুড়িয়ে দিচ্ছে!
দৃশ্যটা ভয়ঙ্কর। আমরা চারজন নির্বাক দাঁড়িয়ে দেখছি। এক চুল নড়ার সাধ্য নেই।
শেষমেশ কিশোর খালি গেলাসটার লেবেল পরীক্ষা করে দেখল।
কমলার রসে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড আছে। হার্টের শরীরটা সাধারণ মানুষের মত ছিল না। যে কারণে পুড়ে গেছে কমলার রসে, ব্যাখ্যা দিল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।
আর কিছু ঘটার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। জানালাটা কোথায়?
নোংরা জানালাটার নীচে পড়ে থাকা জিনিসপত্র সরালাম আমরা। জাদুবলে হাজির করা হার্টের চেয়ার দুটো টেনে আনতে চাইলাম। কিন্তু ও দুটো এমনভাবে কাঁপতে লাগল, এবড়োখেবড়ো জমির উপর দিয়ে হিঁচড়ে নেওয়া হচ্ছে যেন।
মেঝের উপর আলো ফেললাম ফ্ল্যাশলাইটের। লক্ষ করলাম, চেয়ার দুটো দাঁড়িয়ে প্রাচীন এক কবর ফলকের উপর।
ওটার পাশে বসে পড়লাম হাঁটু গেড়ে। দেখতে পেলাম এ্যানিটে লেখা রয়েছে: এখানে ঘুমন্ত বিল হার্টের অনন্ত আত্মা। কোনও তারিখ নেই, নেই কোনও প্রিয়জনের ভালবাসার বাণী।