ঝোপের ধারে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল দুজনে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুতের আলোয় লাগছে রূপালী চাদরের মত।
রবিন বলল, আবার পায়ের শব্দ শুনলাম মনে হলো!
কান পেতে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা বড় ঘরের জানালায় আলো জ্বলতে দেখল ওরা।
এসো, দেখব, উঠে দাঁড়াল কিশোর।
মাথা নিচু করে একছুটে সামনের খোলা জায়গাটুকু পেরোল ওরা। মাথায় আর পিঠে আঘাত হানছে বড় বড় ফোঁটা। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে।
জানালার কাছে পৌঁছে গেল দুজনে। এখানে গীয়ে বৃষ্টি লাগে না। ঘর থেকে কেউ দেখতেও পাবে না ওদের। আরেকটা ছোট জানালার কাছে সরে এল।
জানালাটা অনেক ওপরে। দুই হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে পেটের ওপর রেখে মইয়ের ধাপ তৈরি করল কিশোর। তাতে পা রেখে উঠে দাঁড়াল রবিন। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল।
কি দেখছ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
একটা লিভিং রুম। কাপড়ে মোড়া আসবাব, প্যানেল করা দেয়াল, ঝাড়বাতি। মানুষ নেই।
তাহলে আলো জ্বালল কে?
সুইচ হয়তো অন করাই ছিল। কারেন্ট চলে গিয়েছিল। আবীর এসেছে। আপনাআপনি জ্বলেছে আলোটা।
আর কি আছে?
ভারি দরজা। এককোণে অনেক বড় একটা ঘড়ি, গ্র্যাণ্ডফাদার কুক। সামনের দিকে পুরোটা কাঁচে ঢাকা। পিতলের বিরাট পেণ্ডুলাম। এখান থেকেও টিক টিক শুনতে পাচ্ছি।
টিক টিক? রবিনের ভারে আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। কিশোর। খালি বাড়িতে ঘড়ি চলছে!
রবিনেরও মনে পড়ে গেল নোটটার কথা:
ঘড়ি যখন টিক টিক করবে,
তখন আসবে মরণ!
তুমি নামো, আমি দেখি, কিশোর বলল।
লাফ দিয়ে নামল রবিন।
একই ভাবে তার হাতে ভর দিয়ে উঠে গেল কিশোর।
কে চালাল ঘড়িটা? দেখতে দেখতে বলল সে। নিজের হাতঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিল। একেবারে সঠিক সময়।
দপ করে ঘরের আলো নিভে গেল। আবার ঢেকে গেল অন্ধকারে। ঠিক একই সময়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল তীব্র আলো। বজ্রপাতের বিকট শব্দ হলো।
পরক্ষণে শোনা গেল রক্ত-হিম-করা তীক্ষ্ণ চিৎকার।
.
০৫.
চিৎকার থামতেই কাঠের বারান্দায় শোনা গেল পদশব্দ। পলকের জন্যে দেখা গেল একটা ছায়ামূর্তিকে। লাফ দিয়ে বাগানে নেমে লাফাতে লাফাতে চলে গেল ড্রাইভওয়ের দিকে।
ধরো! ধরো! বলে চিৎকার দিয়েই পিছু নিল কিশোর।
সে ড্রাইভওয়েতে ওঠার আগেই গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল মূর্তিটা। তার জুতোর শব্দ কানে আসছে।
কিশোরকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে রবিন। লোকটাকে দেখতে পেল আবার। গতি বাড়াল সে।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সামনের লোকটা। ছুটতে পারছে না আর তেমন। ধরে ফেলল রবিন।
আবার বিদ্যুৎ চমকাল।
ভীত-সন্ত্রস্ত, পরিচিত মুখটা দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না ওদের।
এ কি! ডুডলি হ্যারিস! মস্ত ধনী। দামী ছবি আর শিল্পকর্ম সংগ্রহের বাতিক আছে। পগিলাটে স্বভাবের জন্যে রকি বীচে অনেকেই চেনে তাকে। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে ভাল খাতির। এই লোক এখানে কি করছে?
রবিন আর কিশোরকে চিনতে পারলেন তিনিও। স্বস্তিতে ঢিল করে দিলেন শরীর। তোমরা!
আপনি এখানে কি করছেন, মিস্টার হ্যারিস? জিজ্ঞেস করল রবিন।
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হ্যারিস বললেন, কিশোর, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো, প্লীজ! থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি। পরিশ্রম, উত্তেজনা এবং এই বৃষ্টিতে ভেজা সইতে পারছেন না আর বুড়ো শরীরে। উফ, কি সাংঘাতিক…কি জঘন্য চিৎকার…।
ধরে ধরে তাকে নিয়ে চলল কিশোর আর রবিন।
গাড়িটা কোথায়, দেখিয়ে দিলেন হ্যারিস। ম্যানিলা রিভার রোডের ধারে একটা বড় ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন। পুরানো মডেলের বিরাট গাড়ি। কাঁপা হাতে দরজা খোলার চেষ্টা করলেন।
বাধা দিল কিশোর, মিস্টার হ্যারিস, কি হয়েছে না বলেই চলে যাবেন? বললে হয়তো কিছু করতে পারতাম।
অসাধু কোন কিছুতে জড়িত নন হ্যারিস, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে।
কিন্তু প্রলাপের মত বকেই চললেন তিনি, কি সাংঘাতিক…বাপরে বাপ…আসা একেবারেই উচিত হয়নি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভুল করেছি…আসলে পান্নাগুলো চুরি হয়ে গেল তো…
কিশোরের দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল রবিন, নিশ্চয় তার পান্নার জিনিসগুলোর কিছু হয়েছে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বলার মত অবস্থাই নেই তাঁর।
গাড়ি চালাতে পারবেন কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।
চিৎকার কে করেছে সেটাও কিন্তু জানা হয়নি, মনে করিয়ে দিল রবিন। মিস্টার ককার এখনও বাড়ির ভেতরে।
আমি যাচ্ছি দেখতে। এক কাজ করো, তুমি গাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে যাও। দেখছ না কি রকম কাঁপছেন। সেবা দরকার। চাচী আছে, চিন্তা নেই। আমি বাড়ির ভেতরটা দেখে তোমার গাড়িটা নিয়ে চলে আসব।
প্রায় চ্যাংদোলা করে হ্যারিসকে গাড়িতে তুলে দিল দুজনে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল রবিন। ততক্ষণে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ির সদর দরজার দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করেছে কিশোর।
ঘরগুলো সব অন্ধকার। সামনের দিকের একটা জানালায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। কিছু দেখা যায় না। সদর দরজার পিতলের ঘণ্টাটা। বাজাল। কেউ সাড়া দিল না।
দরজায় থাবা দিয়ে ককৗরের নাম ধরে ডাকল।
জবাব নেই।
নব ঘুরিয়ে খুলতে গিয়ে দেখল, ঘোরে না। তালা লাগানো।
দ্রুত হেঁটে ঘুরে বাড়ির পেছন দিকে চলে এল সে। পেছনের দরজা বন্ধ, সেলারের দরজা বন্ধ। কোনখান দিয়ে ঢোকার উপায় নেই। চিৎকার করে বার বার ককারের নাম ধরে ডেকেও সাড়া পেল না। বাড়িটা তেমনি অন্ধকার, নীরব হয়ে আছে।