হাঁপাতে হাঁপাতে রবিন বলল, ভালই সার্কাস দেখলাম আমরা, কি বলো! আর কোন কাজ না পেলে দড়াবাজিকর হয়েও ভাত জোগাড় করতে পারব।
.
২৫.
বাতাস অনেক কমে গেছে, তাই রক্ষা। গোরোকে নিয়ে ছাতের ওপর দিয়ে চিলেকোঠার জানালার দিকে এগোতে অতটা অসুবিধে হলো না ছেলেদের। নিচে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। উইককে খুঁজতে ব্যস্ত পুলিশ। গোয়েন্দাদের খোঁজ এখনও পড়েনি নিশ্চয়।
জানালা টপকে ভেতরে ঢুকল প্রথমে রবিন আর কিশোর। নিচে থেকে গোরোকে ওপর দিকে ঠেলে দিল মুসা। তাকে টেনে তুলে অনিল দুজনে। মুসা ঢুকল সবার শেষে।
ভয়ানক পরিশ্রম গেছে। চিলেকোঠার মেঝেতেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
দুর্বল ভঙ্গিতে ছেলেদের দিকে তাকাল গারো, তোমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। নিজের প্রাণের বিন্দুমাত্র মায়া করলে না! সত্যি বলছি, এত বয়েস হলো, এ রকম ছেলে আমি দেখিনি! তোমরা একেকটা হীরের টুকরো!
কিশোর ও মুসাকে বলল রবিন, আর আমার নেই তোমাদের দুজনকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা! ছাতের কিনার ধরে ঝুলে পড়ার পর একবারও ভাবিনি আজ বেঁচে ফিরে আসতে পারব।
মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর, খাওয়া নিয়ে আর তোমাকে ঠাট্টা করব না, মুসা। যত মন চায় খেয়ো। তোমার ওই গণ্ডারের শক্তিই কেবল আজ দুটো প্রাণিকে রক্ষা করল! ধন্যবাদ।
দরাজ হাসি হাসল মুসা, শুকনো ধন্যবাদে কাজ হবে না। আজ রাতেই শিক কাবাব খাওয়াতে হবে। বিশ-পঁচিশ, যতটা খেতে চাই। পয়সার মায়া করতে পারবে না।
করব না। চলো, উইককে পাওয়া গেল কিনা দেখি।
নামতে শুরু করল ওরা। সবার পেছনে আসতে আসতে চিৎকার করে উঠল গোরো, আমার আবিষ্কার! ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা!
গোরোকে যেতে দিলে আবার কোন বিপদ বাধাবে। তাই কেউ বাধা দেয়ার আগেই আবার ছুটে চিলেকোঠায় উঠে গেল রবিন। জানালা গলে ছাতে নেমে পড়ল। চিমনির দিকে রওনা হলো। চিমনির কাছে এসে একহাতে চিমনি ধরে আরেক হাত ফোকরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতড়াতে শুরু করল।
কি যেন হাতে লাগল। বের করে আনল সেটা। তারের একটা বাণ্ডিলের মত জিনিস। একমাথায় একটা অদ্ভুত যন্ত্র লাগানো। সেটা পকেটে ভরে চলে এল আবার জানালার কাছে।
তাকে ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করল মুসা। ছাতে ঘোরার নেশায় পেল, নাকি আজ তোমাকে? ঘটনাটা কি?
পকেট থেকে জিনিসটা বের করল রবিন। মিস্টার কিনডার…
সে কথা শেষ করার আগেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল গোরে। ধকল সহ্য করতে পারেনি আর তার বুড়ো শরীর।
ধরাধরি করে তাকে নিচের লিভিং রুমে নিয়ে এসে একটা লম্বা সোফায় শুইয়ে দেয়া হলো।
এই সময় ঘরে ঢুকলেন ফ্লেচার। সঙ্গে আরেকজন লোক। মাথায় স্ট্র হ্যাট।
মিস্টার ককার! বলে উঠল রবিন।
দ্রুত এগিয়ে এলেন ব্যাংকার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক, তোমরা ভালই আছ। তোমাদের কিছু হলে নিজেকে…
বাধা দিল কিলোর, আমরা ঠিকই আছি। তবে মিস্টার কিনডারের সাহায্য লাগবে। বেহুশ হয়ে গেছে।
একজন অফিসারকে গাড়ি থেকে ফার্স্ট এইড বক্স আনতে পাঠালেন চীফ।
ছাতের ওপর ওদের ভয়াবহ অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলল ছেলেরা।
পকেট চাপড়ে রবিন বলল, মিস্টার কিনডারের আবিষ্কার এখন আমার পকেটে।
চীফ জানালেন, উইককে পেলাম না। রোডব্লকের আদেশ দিয়ে দিয়েছি। আমি। শহর থেকে বেরোতে যাতে না পারে। সাংঘাতিক পিচ্ছিল চোরটা! একেবারে পাকাল মাছ!
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে থমকে গেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, গোলাঘরটায় খুঁজেছেন?
কোন গোলাঘর?
যেটাতে গাড়ি লুকিয়েছিল?
মাথা নাড়লেন চীফ। না। মরিস আসেনি, আমরা ওটা চিনিও না, মনেও পড়েনি।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর, রবিন, মুসা, এসো আমার সঙ্গে! বলেই চীফ বাধা দেয়ার আগে রওনা হয়ে গেল দরজার দিকে।
বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ঘন হতে আরম্ভ করেছে কুয়াশার চাদর। ভোঁতা করে দিয়েছে জানালার হলদে আলোগুলোকে। ঘন ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা।
গোলাঘরে গিয়ে ঢুকেছে ভাবছ নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ।
পেছনে ফিরে তাকাল মুসা। কুয়াশার জন্যে আলোগুলোকে কেমন বিচিত্র লাগছে। টর্চ জ্বালতে গেল।
বাধা দিল কিশোর, জেলো না। উইক দেখলে হুশিয়ার হয়ে যাবে। কিছুই যাতে টের না পায়। চমকে দিতে হবে ওকে।
গাছে তৈরি সুড়ঙ্গমুখের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। লতাপাতার ঢাকন। ফাঁক করল রবিন। ভেতরে পা রাখল তিনজনে। টানটান হয়ে আছে স্নায়ু। আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত।
রাত শেষ হয়ে এসেছে। পুবের আকাশে হালকা আলো। সুড়ঙ্গে সেটা প্রবেশ করছে না। এখানে ঘন কালো অন্ধকার। শঙ্কিত হলে কি এই অন্ধকারে বসে থাকলে নিশ্চয় চোখে সয়ে গেছে উইকের। ওরা নাম আগেই না ওদেরকে দেখে ফেলে।
ঝুঁকি নিয়েও তাই টর্চ জ্বালার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।
অন্ধকারের কালো চাদর ছুঁড়ে দিল তীব্র আলোক রশ্মি। সেই আলোয় পথ দেখে দ্রুত এগোল ওরা।
গোলাঘরে ঢুকল। খড়ের গাদা আগের মতই আছে। তবে সামনের দিকের কিছু খড় মাটিতে পড়ে আছে। বেরিয়ে আছে গোপন গ্যারেজের প্রাই উডের দরজা। ভেতরে উঁকি দিল সে।
দেয়ালের কাছে খুট করে একটা শব্দ হতেই পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল তিনজনে। মুসার হাতের টর্চের আলো গিয়ে সোজা পড়ল উইকের মুখে। ভিজে, কুঁকড়ে আছে তার কাপড়-চোপড়। চোখে ব্রুনো দৃষ্টি। খড় সরানোর যন্ত্রটা তুলে নিয়েছে। মারাত্মক কাটাগুলো যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে।