তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই টর্চের আলোয় ঝোপঝাড় আর গাছপালার মধ্যে উইককে খুঁজতে লাগল ওরা। কিন্তু তার ছায়াও দেখা গেল না আর।
হঠাৎ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হলো। ছুটে ড্রাইভওয়েতে ঢুকল ওটা। আচমকা ব্রেক কষে থামানোর চেষ্টা করায় কর্কশ আর্তনাদ তুলল টীয়ার। হেডলাইটের আলো পড়েছে বাড়িটর সামনের অংশে।
পুলিশ! চিৎকার করে বলল মুসা।
টপাটপ লাফিয়ে নামল ছয়জন পুলিশ অফিসার। ছুটে এল ওদের দিকে।
সবার আগে রয়েছেন পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচার। যাক, পাওয়া গেল। কিশোর, তোমার চাচী তো অস্থির হয়ে পড়েছেন…
মুসার কাছে শুনেছি। পরে সব বলব। আগে উইককে খুঁজে বের করা দরকার।
উইকের কি হয়েছে, অল্প কথায় চীফকে জানাল কিশোর। বলল, আমার ধারণী বেরোতে পারেনি, এ বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে। সারাক্ষণ টর্চ জ্বেলে রেখেছি আমরা। আড়াল থেকে বেরোলে আমাদের চোখে পড়তই। এখন আপনারা এসে গেছেন। আর বেরোনোর সাহস পাবে না। ওকে বের করে আনতে হবে।
চিৎকার করে সহকারীদের নির্দেশ দিলেন চীফ, বাড়ির চারপাশে খোঁজো। খেয়াল রেখো, কোনমতেই যেন পেছন দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। বাড়িতে যত আলো আছে, সব জ্বেলে দাও।
ককারও সম্ভবত এ বাড়িতেই আছেন, কিশোর বলল। তাকেও খুঁজতে হবে।
চীফ বললেন, তার জন্যে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি অফিস থেকে বেরোনোর ঠিক আগে ফোন করেছেন। সারাদিন শহরের বাইরে ছিলেন। তোমাদের বাড়িতেই করেছিলেন। তোমার চাচীর কাছে তোমাদের নিখোঁজ হবার খবর পেয়েছেন। যে কোন মুহূর্তে এখানে চলে আসতে পারেন।
আলোয় আলোকিত হয়ে গেল বাড়িটী।
খাইছে! হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা। ওপর দিকে হাত তুলে দেখাল।
দেখে বরফের মত জমে গেল যেন কিশোর।
টালির ছাতের কিনার ধরে ঝুলছে দুটো ছায়া।
রবিন আর গেরো!
একহাতে গোরোকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে রবিন। আরেক হাতে টালির কিনার খামচে ধরে ঝুলে আছে।
পাশে তাকাল কিশোর। মুসা নেই। চিৎকার করেই সরে গেছে। ঢুকে যাচ্ছে আবার বাড়ির ভেতর।
তার পেছনে ছুটল কিশোর। প্রার্থনা করল, খোদা, আমরা না যাওয়া পর্যন্ত আটকে রাখো ওদের! পড়তে দিয়ো না!
চিলেকোঠার জানালার কাছে পৌঁছে গেল ওরা।
মুসা বলল, আমি নেমে যাচ্ছি। তুমিও এসো। আমার গোড়ালি চেপে ধরে রাখবে।
কিশোর বলল, না, আমি জোরে পারব না। ভার রাখতে পারব না। এতজনের। আমি ওদের তোলার চেষ্টা করব, তুমি ধরে রেখো।
আপত্তি করল না মুসা।
ভেজা, পিচ্ছিল ছাতে নেমে গেল ওরা। কমে এসেছে বৃষ্টি। কিন্তু নতুন আপদ দেখা দিয়েছে। কুয়াশা জমতে আরম্ভ করেছে। বুড়ো আঙুল বাঁকা করে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।
এখনও ঝুলে আছে রবিন। দেয়ালের গায়ে ছাতের একপাশে টালি যেখানে গাঁথা হয়েছে, তার কাছাকাছি রয়েছে। নিশ্চয় টালির খাজে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে সে, নইলে একটা সেকেণ্ডও ঝুলে থাকা সম্ভব হত না।
টর্চ জ্বেলে দেখল কিশোর, টালিতে নয়, কিনার দিয়ে চলে যাওয়া ছাতের পানি নিষ্কাশনের পাইপ আঁকড়ে ধরে ঝুলছে রবিন। গোরোও এখন পুরোপুরি রবিনের ওপর ভর দিয়ে নেই, তার একটা হাতও পাইপ চেপে ধরেছে। তাতে অনেকটা ভার কমেছে রবিনের ওপর থেকে।
একপাশের দেয়ালের যে শিরাটা বেরিয়ে আছে, সাইকেলের সীটে বসার মত করে তাতে বসল মুসী। দুই পা আর গোড়ালি দিয়ে দুদিক থেকে চেপে ধরুল দেয়ালটা। কিশোরকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বলল।
মাথা নিচে পা ওপর দিকে করে ঢালু ছাতে শুয়ে পড়ল কিশোর। শক্ত করে তার গোড়ালি চেপে ধরল মুসা।
সামনে হাত লম্বা করে দিল কিশোর। কিন্তু অল্পের জন্যে রবিনের হাতের নাগাল পেল না। বলল, মুসা, পারছি না!
খুব সাবধানে শিরাটার ওপর ঘষটে ঘষটে আরও কয়েক ইঞ্চি নামল মুসা। হাত এগিয়ে গেল কিশোরের। তার আঙুলগুলো রবিনের হাত ছুঁতে পারল। রবিনের কব্জি চেপে ধরল। বলল, রবিন, ছেড়ে দাও! তোমার আঙুলগুলো দিয়ে আমার কব্জি পেঁচিয়ে ধরো!
ধরল রবিন। আরেক হাতে গোরোকে ঠেলতে লাগল ওপর দিকে, ছাতে তুলে দেয়ার জন্যে।
অন্য হাত দিয়ে গোরোর হাত চেপে ধরল কিশোর। টানতে লাগল ওপর দিকে।
সাংঘাতিক কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক একটা কাজ। তবে সফল হলো সে। আস্তে আস্তে ওপর দিকে উঠে আসছে গোরো।
দুর্বল হয়ে পড়েছে রবিন। কিশোরের হাতে তার ভার পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে গোরোকে আরও জোরে ঠেলতে লাগল।
অবশেষে ছাতে উঠে এল গোরো। উপুড় হয়ে তাকে চুপ করে শুয়ে পড়তে বলল কিশোর। পড়ে থাকুক। রবিনকে তুলে আনার পর তার ব্যবস্থা করবে।
সবচেয়ে বেশি ভার বহন করতে হচ্ছে মুসাকে। কিন্তু একচুল ঢিল করল না আঙুলের চাপ। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রইল সে।
রবিনও উঠে এল ওপরে। কিশোরের হাতে চাপ অনেকখানি কমল।
তুমি গোরোর পা ধরো, কিশোর বলল। আমি তাকে ধরে রাখছি।
খুব ধীরে তাড়াহুড়ো না করে একটা মানব-শেকল তৈরি করল ওরা। মুসা। ধরে রেখেছে কিশোরের পা। কিশোর ধরল গৌরোর দুই হাত। রবিন ধরল গোরোর দুই পাঁ। পিচ্ছিল ছাতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পরের তিনজন। টেনে টেনে তাদেরকে সরিয়ে আনতে শুরু করল মুসা।
অবশেষে ছাতের কিনার থেকে সরে এল সবাই।
কিশোর আর রবিনও শিরা আঁকড়ে ধরে হাঁপাতে লাগল।
এই ভয়াবহ টানাটানিতে একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে গোরো। তাকে ধরে রাখল মুসা।