অন্যেরাও গাঁ ঘেষাঘেষি করে এল ফাঁকে চোখ রাখার জন্যে। থমকে দাঁড়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে। ছেঁড়া তারগুলো দেখল। যে চেয়ারে বন্দিরা বাঁধা ছিল, ওগুলো দেখল শূন্য। কাটা দড়ি পড়ে আছে মেঝেতে।
ধরতে বেরোব নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মাথা নাড়ল কিশোর, এখন না।
উন্মাদ হয়ে গেল যেন উইক। রাগে লাল হয়ে গেল মুখ। হ্যাঁচকা টানে একটা চেয়ার তুলে মেঝেতে বাড়ি মেরে ভাঙল। চিৎকার করে বলতে লাগল, পালিয়েছে! কি ভাবে…
টান দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করল। ছাতের দিকে তুলে ট্রিগার টিপতে শুরু করল। ম্যাগাজিনের গুলি শেষ না করে থামল না।
খালি করে ফেলেছে! ফিসফিস করে বলল রবিন। ভাল!
পিস্তলটা মেঝেতে আছড়ে ফেলে চারপাশে তাকাতে লাগল উইক। দুচোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আচমকী হেসে উঠল অট্টহাসি। হুমকি দিয়ে নোট রেখে আসার কথা প্রমাণ করতে পারবে না ওরা, যদি আমি আবিষ্কারটা ধ্বংস করে দিইগোরোর মহামূল্যবান আবিষ্কার…– ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।
না না! দম আটকে যাবে যেন গারোর। ওকে এ কাজ করতে দেয়া যাবে না! আটকাতে হবে!
চলুন! সোজা হয়ে দাঁড়াল কিশোর।
গুপ্তঘর থেকে বেরিয়ে এল চারজনে। দৌড়ে ঢুকল সামনের হলঘরে।
অন্ধকার সিঁড়িতে শোনা গেল উইকের গর্জন, বিচ্ছুর দল! সর্বনাশ করে দিয়েছে সব! আমি ওদের ছাড়ব না!
সিঁড়িতে পা রাখল গোরো। নিঃশব্দে উঠতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা। আবিষ্কার বাঁচানোর জন্যে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে বুড়ো মানুষটা, ছেলেদেরও পেছনে ফেলে দ্রুত উঠে যাচ্ছে।
মিস্টার কিনডার, সাবধান! ডেকে বলল রবিন।
ছাতে ওঠার আগেই শয়তানটাকে থামাতে হবে!
সিঁড়ির মাথায় এসে দম নেয়ার জন্যে থামল সে।
পাশে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
ওপরে তাকাল কিশোর। আরও সিঁড়ি আছে। চিলেকোঠায় উঠে গেছে। ওপরের দিকে করে টর্চ জ্বালল। আলোক রশ্মিতে ধরা পড়ল উইক। শিপরিজের মুখ, মুখ বিকৃত করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
উইক, আর শয়তানির চেষ্টা করে লাভ নেই, কিশোর বলল, আপনার চেয়ে সংখ্যায় আমরা অনেক বেশি। গায়ে যত জোরই থাক, চারজনের সঙ্গে পারবেন না। নেমে আসুন। জলদি!
নড়ল না উইক। চোখের খেপা দৃষ্টি আরও খেপা হচ্ছে।
নামুন বলছি! ধমক দিয়ে বলল রবিন। আপনার জারিজুরি খতম!
নড়ে উঠল উইক। ওপর থেকে ঝাঁপ দিল ওদের লক্ষ্য করে। ভারি শরীর নিয়ে ভয়াবহ গতিতে এসে পড়ল ওদের ওপর। সবাইকে ফেলে দিল। ওরা যখন সিঁড়িতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, রেলিং ধরে উঠে দাঁড়াল সে। লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যেতে শুরু করল।
ধরো ওকে, মুসা, চিৎকার করে উঠল কিশোর, ওকে পালাতে দেয়া যাবে না। আমিও আসছি! রবিন, তুমি যাও মিস্টার কিনডরের সঙ্গে। ওপরে চলে যাচ্ছে। ছাতে উঠতে দিয়ো না তাকে। এই শরীর নিয়ে উঠতে গেলে মারা পড়বে!
কিশোরের কথা শেষ হওয়ার অনেক আগেই উঠে পড়েছে মুসা। উইকের পিছু নিয়েছে।
রবিন উঠে গেল চিলেকোঠায়। গোরোকে দেখতে পেল না। ঝোড়ো বাতাসে ঝাঁপটা দিয়ে খুলে ফেলল সামনের একটা জানালার পাল্লা। ওটার কাছে ছুটে এসে বাইরে উঁকি দিল সে।
এখনও মুষলধারে পড়ছে বৃষ্টি। ঠাণ্ডা, প্রবল ঝোড়ো বাতাস বইছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এখনও, তবে অনেক দূরে সরে গেছে।
গেল কোথায় গোরো!–ভাবল রবিন। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পিচ্ছিল ছাতে ওঠার চেষ্টা করলে পিছলে পড়ে মরবে।
জানালাটা দিয়ে ঢালু ছাতের একাংশ চোখে পড়ে। অন্ধকারের মধ্যেও আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে চিমনিটা।
গোরো! অস্ফুট স্বরে বলে উঠল রবিন।
এক হাতে চিমনি পেচিয়ে ধরেছে ভিজে চুপচুপে বুড়ো মানুষটা। ইটের তৈরি চিমনির গোড়ায় পা রেখে, কনকনে ঝোড়ো বাতাস আর তুমুল বৃষ্টির পরোয়া না করে, আরেক হাত বাড়িয়ে খুঁজছে কি যেন।
পড়ে মরবে! বাঁচাতে হলে এখুনি যেতে হবে আমাকে।ভাবল রবিন।
দেরি করল না সে। জানালা গলে নেমে পড়ল স্লেটপাথরে তৈরি পিচ্ছিল টালির ছাতে। তার পাহাড়ে চড়ার সমস্ত অভিজ্ঞতা আর প্র্যাকটিস এক করে ভারসাম্য বজায় রেখে খুব সাবধানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চলল চিমনিটার দিকে।
চিৎকার করে ডাকল, মিস্টার কিনডার, নড়বেন না, আমি আসছি!
ফিরে তাকাল বৃদ্ধ। বলল, ঠিক আছে। ওটা পেয়ে গেছি আমি। নড়ার আর দরকার নেই আমার।
গোরোর পাশে চলে এল রবিন। শান্ত হয়ে আমাকে ধরে থাকুন। আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাব আমরা। সমস্ত ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। নিজে কিছু করার চেষ্টা করবেন না।
চিমনি ছেড়ে দিয়ে ওরা ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড এক ঝলক ঝেড়ো বাতাস এসে ঝাঁপটা মারল। টলিয়ে দিল গোরোকে। সামলাতে পারল না সে। কাত হয়ে পড়ে যেতে শুরু করল। সেই সঙ্গে রবিনকেও কাত করে দিল।
ঠেকাতে পারল না রবিন। পড়ে গেলে দুজনে। গড়াতে শুরু করল ছাতের ঢালে। দ্রুত সরে যেতে লাগল কিনারের দিকে।
.
২৪.
বাইরে চলে গেল উইক।
মুসা আর কিশোরও বেরিয়ে এল।
টর্চ জ্বেলে এদিক ওদিক দেখতে লাগল কিশোর। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে। গেছে লোকটা।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা, দিল মনে হয় গোল খাইয়ে আমাদের!
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, সে-রকমই তো মনে হচ্ছে। ও যে ওরকম করে। ঝাঁপ দিয়ে পড়বে, কল্পনাই করিনি!